
রফিকুল ইসলাম রাজুঃ
ঢাকার ব্যস্ত রাস্তাগুলো সকাল হতেই জীবন্ত হয়ে ওঠে। রাস্তার বুকে হরেক রঙের যানবাহন-রিকশা, বাস, বাইক-সবই একটি নিরব যুদ্ধের অংশ। এই নগর জীবনের ধ্রুবক রিদমে আমরা অনেক কিছু দেখি, কিন্তু যারা শহরের প্রতিটি খাবার আমাদের হাতে পৌঁছে দেয়, তাদের সংগ্রামকে খুব কমই চোখে পড়তে দেখি। এই গল্প সেই নিঃশব্দ নায়কদের—ফুড ডেলিভারি রাইডারদের জীবনযুদ্ধকে নিয়েই। প্রতি সকালে সূর্য ওঠার আগেই, শহরের রাস্তায় দেখা যায় বাইক আর সাইকেল হাতে নেয়ার মানুষেরা।
তারা কোনো অফিসে যায় না, কোনো ডেস্কের পেছনে বসে কাজ করে না, কিন্তু তাদের কাজ শহরের জীবনকে সচল রাখে। রোদ, বৃষ্টি, ঘন ট্রাফিক-সব কিছু পার হয়ে তারা ছুটে চলে, শুধু একটি খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দিতে। অনেক সময় মানুষ তাদের প্রতি অনুশোচনা বা ধন্যবাদ জানায় না, কিন্তু তারা থামে না। এই নিঃশব্দ সংগ্রামই তাদের ‘দৈনন্দিন যুদ্ধ’। ফুড ডেলিভারি রাইডারদের জীবন সাধারণ মানুষের কাছে সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।
একটি আদেশ পৌঁছে দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইকে থাকা, রাস্তার প্রতিটি বাঁক, ট্রাফিক জ্যাম, অযাচিত বৃষ্টিপাত, গরম রোদ-সবই তাদের দিনের অংশ। অনেকে দিন শেষে ক্লান্ত মুখে ঘরে ফিরে যায়, কিন্তু পেটে যে ক্ষুধা আছে, তা তারা সামলাতে শেখে। ঢাকার রাস্তায় দেখা যায় অগণিত রাইডার। কেউ ব্যস্ত রাস্তায় হর্ন বাজিয়ে পথ খুঁজছে, কেউ মোবাইল স্ক্রিনে অর্ডার চেক করছে। প্রতিটি অর্ডারের পিছনে থাকে সময়ের দৌড়, প্রতিটি মিনিটের সাথে লড়াই। কিছু রাইডার বলেন, দুপুরে খাবার খেতে পারি না।
অনলাইনে না গেলে পয়েন্ট কেটে নেয়। আয় ঠিকমতো হয় না। এই কথাগুলো শোনার পর বোঝা যায়, তারা দিনের শেষে শুধু খাবার পৌঁছায় না, তারা ঘাম আর শ্রম দিয়ে শহরের সার্বিক জীবনকে সচল রাখে। তাদের সংগ্রাম শুধু বাইকের চাকা ঘুরানো নয়, এটি পরিবারকে সচল রাখারও যুদ্ধ। বাড়িতে ফিরে ছোট সন্তান তাদের খোলাসূত্রে আলিঙ্গন করে, স্ত্রী পানি বা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লান্ত মুখের পেছনেও লুকিয়ে থাকে স্বপ্ন-বাচ্চার হাসি, পরিবারকে সুখী করা, আর কখনো নিজস্ব জীবনের ছোট আনন্দ।
এক রাইডারের কথায়, ছেলেটা বলে-আব্বু, তুমি কখন অফিসে যাবে? আমি হেসে বলি—এই বাইকটাই আমার অফিস। এই কথাটিই বোঝায় তাদের সংগ্রাম শুধু নিজেদের জন্য নয়, পরিবার ও সন্তানদের জন্যও। ফুড ডেলিভারি রাইডারদের জীবনে প্রতিনিয়ত ঝুঁকি রয়েছে। দুর্ঘটনা, ছিনতাই, কখনও কখনও পথের হঠাৎ বাধা-সবই তাদের সাধারণ দিনের অংশ। কেউ বলেন, রাতের ডেলিভারিতে ছিনতাই হয়েছিল। মোবাইল, খাবার সব চলে গেল। তবুও পরদিন আবার বের হয়েছি। এই দৃঢ় মানসিকতা, ধৈর্য এবং দায়িত্ববোধই তাদের প্রকৃত নায়কীকে প্রতিফলিত করে। তাদের প্রতি সচেতন নাগরিকদেরও কিছু দায়িত্ব আছে।
প্রতিটি অর্ডারের সঙ্গে শুধুমাত্র টাকা নয়, আমাদের সহমর্মিতা, আমাদের ধৈর্য এবং শ্রদ্ধাও যুক্ত হয়। কখনও কখনও একটি ‘ধন্যবাদ’ বা সামান্য সহানুভূতিশীল আচরণ তাদের দিনকে পরিবর্তন করতে পারে। এক রাইডারের কথায়, যদি সবাই একে অপরকে সম্মান দেয়, আমরা শক্তি পাই। বাস্তবেই, এই সামান্য মানবিকতা তাদের জীবনকে সহজ এবং নিরাপদ করতে সাহায্য করে। ফুড ডেলিভারি রাইডারদের জীবনের আরেকটি দিক হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। অনেকেই কম মজুরি, অনিশ্চিত ইনকাম এবং অতিরিক্ত খরচের মধ্যে জীবনযাপন করে।
প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার বেশি বাইকে থাকা, জ্বালানি খরচ, খাবারের খরচ-সব মিলিয়ে একটি স্থিতিশীল জীবনধারার জন্য তাদের সংগ্রাম অপরিসীম। তবে তারা থেমে থাকে না, কারণ তাদের সংগ্রামের পেছনে থাকে পরিবার ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কিছু কোম্পানি রাইডারদের জন্য বোনাস বা সুবিধা দেয়, তবে তা সবার জন্য সমানভাবে পৌঁছায় না। তাই রাইডারদের মধ্যে নিজেদের মধ্যে সহমর্মিতা এবং একে অপরকে সাহায্য করার প্রবণতা দেখা যায়। কেউ জরুরি পরিস্থিতিতে অন্য রাইডারের অর্ডার সম্পন্ন করে দেয়, কেউ বাইকে যাত্রার সময় বিপদ দেখা দিলে সাহায্য করে। এই একতা এবং মানবিকতা তাদের জীবনকে দৃঢ় করে।
শহরের প্রতিটি কনডিশন, প্রতিটি আবহাওয়া তাদের জন্য পরীক্ষা। কিন্তু তারা থেমে থাকে না। কারণ তাদের সংগ্রাম শুধু নিজস্ব জীবন নয়, এটি সমাজকে সচল রাখার যুদ্ধ। তারা আমাদের শহরের নিঃশব্দ নায়ক, যারা আমাদের প্রতিদিনের খাবার, সময় এবং আনন্দ পৌঁছে দেয়। শেষত, ফুড ডেলিভারি রাইডারদের জীবন শেখায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাঠ-সমাজের প্রতিটি মানুষই মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে, আমরা একসাথে এক সুন্দর এবং মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। তাদের ঘামে শহর সচল থাকে, তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম আমাদের জীবনকে সহজ করে।
আসুন, আমরা তাদের প্রতি সম্মান দেখাই, সহমর্মিতা দেখাই, এবং তাদের জীবনকে স্বীকৃতি দিই। যদি প্রতিদিনের ডেলিভারি রাইডারের সংগ্রাম আমাদের হৃদয়ে পৌঁছায়, আমরা বুঝতে পারব-একটা ছোট ভালো কাজ, একটি হাসি বা ধন্যবাদ কতো বড় শক্তি যোগাতে পারে। এই নিঃশব্দ নায়কদের জীবন আমাদের জন্য শিক্ষার উৎস। তাদের জন্য একটু সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা যথেষ্ট, যা পুরো সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারে।
এশিয়ানপোস্ট / এফআরজে