রফিকুল ইসলাম রাজু
প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কো এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। মূল উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষক সমাজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা। বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ শুধু একটি আনুষ্ঠানিক পালনের দিন নয়, বরং শিক্ষার মূল চালিকাশক্তি—শিক্ষককে স্মরণ করার দিন।
শিক্ষা মানব সভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। এই শিক্ষা মানুষের ভেতর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও মানবিকতার বীজ বপন করে। আর সেই জ্ঞানের আলো মানুষকে পৌঁছে দেন শিক্ষক। শিক্ষকের অবদানকে স্বীকৃতি জানাতেই প্রতিবছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়। বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের সম্মান জানানো, তাদের অধিকার রক্ষা করা এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা তুলে ধরা।
শিক্ষক শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান প্রদান করেন না, বরং শিক্ষার্থীর ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলেন। তিনি একদিকে পথপ্রদর্শক, অন্যদিকে অনুপ্রেরণার উৎস। ইতিহাসে আমরা দেখি, মহান শিক্ষকরা যুগে যুগে সমাজকে পরিবর্তন করেছেন। সক্রেটিস, রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো মানুষরা শিক্ষকতাকে শুধু পেশা হিসেবে নেননি, বরং মানবিক উন্নয়নের হাতিয়ার করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন—প্রতিটি ঐতিহাসিক পর্বে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক—প্রত্যেকে সমাজ গঠনে অবদান রেখে চলেছেন। আজও প্রান্তিক অঞ্চলের হাজারো শিক্ষক সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়েও আলোর প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন।
যদিও শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম, কিন্তু বাস্তবতায় তারা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা, কম বেতন, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা—এসব সমস্যা শিক্ষক সমাজকে জর্জরিত করছে। করোনাকালে আমরা দেখেছি, কীভাবে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষকরা সীমাহীন কষ্ট স্বীকার করেও শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন। অথচ সেই ত্যাগের তুলনায় তাদের প্রাপ্য সম্মান বা সুবিধা অনেক কম।
চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে শিক্ষকের ভূমিকাও পাল্টে যাচ্ছে। এখন শিক্ষক কেবল পাঠদানকারী নন; বরং তিনি হচ্ছেন এক ফ্যাসিলিটেটর বা সহায়তাকারী, যিনি শিক্ষার্থীকে সমালোচনামূলক চিন্তা, গবেষণা, সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধে গড়ে তোলেন। ইন্টারনেট ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে শিক্ষার্থীরা প্রচুর তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু সেই তথ্যকে জ্ঞানে রূপান্তর করার কাজ শিক্ষকই করেন।
শিক্ষক শুধু পাঠ্যপুস্তকের অক্ষর শেখান না, তিনি মানুষের চরিত্র গঠন করেন, মানুষকে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার মতো শক্তি জোগান। আমাদের সমাজে যেমন বলা হয়—“শিক্ষক হলেন জাতির আলোকবর্তিকা।” সত্যিই, একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতি নির্ভর করে শিক্ষকের হাতে গড়া শিক্ষার্থীদের উপর। একজন সৎ, দক্ষ ও আদর্শ শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীর ভেতর নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, মানবিকতা ও দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে।
আজকের এই দিনে যখন আমরা বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করি, তখন আসলে আমরা শুধু তাদের শ্রদ্ধা জানাই না, বরং স্মরণ করি শিক্ষকের অবদানকে। শিক্ষকরা প্রায়শই নীরবে, বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা না করেই পরিশ্রম করে যান। অথচ তাদের পরিশ্রমেই গড়ে ওঠে একেকটি প্রজন্ম, গড়ে ওঠে জাতির ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের দেশে শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁরা নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, স্বল্প বেতন, প্রশিক্ষণের অভাব— এসব চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের কাছে নিরলসভাবে জ্ঞান পৌঁছে দিচ্ছেন। এই ত্যাগ স্বীকারের কারণে আজও সমাজে শিক্ষা বিস্তৃত হচ্ছে এবং নতুন প্রজন্ম আলোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে প্রযুক্তি শিক্ষাক্ষেত্রে বিশাল পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল যুগে শিক্ষকরা শুধু জ্ঞানের বাহক নন, বরং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জ্ঞান অর্জনে সহায়তা করছেন। অনলাইন ক্লাস, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার, ভার্চুয়াল লার্নিং— সবই শিক্ষকের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। তবে এর পাশাপাশি শিক্ষকদেরও নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রয়োজন, যাতে তাঁরা যুগোপযোগীভাবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারেন।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষকদের অধিকার সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারণ একজন শিক্ষক যদি যথাযথ সম্মান, সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা না পান, তবে তিনি তার সর্বোচ্চ যোগ্যতা দিয়ে কাজ করতে পারবেন না। শিক্ষকেরা কেবল পেশাজীবী নন, তাঁরা জাতি গঠনের কারিগর। তাই তাদের জীবনমান উন্নয়ন ও পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করা জরুরি।
একজন ভালো শিক্ষক আজীবন শিক্ষার্থীর মনে স্মরণীয় হয়ে থাকেন। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের জীবনে এমন একজন শিক্ষকের নাম বলতে পারব, যিনি আমাদের জীবন গড়ার পেছনে অনন্য অবদান রেখেছেন। তাঁদের ছাড়া আমরা হয়তো আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম না।
শিক্ষকের অবদানকে শ্রদ্ধা জানানো শুধু একটি দিনের আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি হওয়া উচিত আমাদের প্রতিদিনের আচরণে। শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, তাদের পরিশ্রমকে মূল্যায়ন করা, এবং তাদের জন্য একটি উন্নত পরিবেশ তৈরি করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
বিশ্ব শিক্ষক দিবস হোক শিক্ষকদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি— শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান দেব, তাদের কাজকে মূল্যায়ন করব এবং শিক্ষা বিস্তারে তাঁদের পাশে থাকব। কারণ শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয়, আর শিক্ষা ছাড়া শিক্ষকের অস্তিত্ব নেই। তাই শিক্ষকই জাতির প্রকৃত নির্মাতা, এবং তাঁদের অবদান মানবসভ্যতার ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে।
এশিয়ানপোস্ট / এফআরজে