রফিকুল ইসলাম রাজুঃ
বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি অর্জন করেছে। গার্হস্থ্য উৎপাদন, শিল্প ও সেবা খাতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু দেশের একটি গুরুতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা হলো তরুণ বেকারত্ব, যা জাতীয় অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের তরুণ বেকারত্বের মূল কারণ, প্রভাব এবং সমাধানের পথ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বেকারত্ব বলতে আমরা সাধারণত সেই অবস্থাকে বুঝাই যেখানে চাকরির জন্য যোগ্য ও ইচ্ছুক ব্যক্তি কিন্তু চাকরি পায় না। তরুণ বেকারত্ব বলতে সাধারণত ১৫–২৯ বছর বয়সী যুবকদের মধ্যে কর্মসংস্থানের অভাব বোঝানো হয়। বাংলাদেশে এই বয়সী জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫–৪০ শতাংশ। অর্থাৎ, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোতে এই তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১০–১৫ শতাংশ। যদি অ-নিয়মিত ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানও বিবেচনা করা হয়, তবে বাস্তব চিত্র আরও জটিল।
বাংলাদেশে তরুণ বেকারত্বের মূল কারণগুলো বহুমাত্রিক। শিক্ষাব্যবস্থা অনেক সময় তত্ত্বকেন্দ্রিক। শিক্ষার্থীরা চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় প্র্যাকটিক্যাল ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এখনও চাকরির বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ শিক্ষাদান করছে না। উদাহরণস্বরূপ, তথ্যপ্রযুক্তি, ডেটা অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল মার্কেটিং, দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারিং প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রথাগত কোর্সে সীমাবদ্ধ থাকে। এছাড়া ইন্টার্নশিপ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব শিক্ষিত যুবকদের চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেয়।
অর্থনৈতিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতাও বড় কারণ। যদিও দেশের অর্থনীতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, চাকরির সংখ্যা শিক্ষিত তরুণদের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নয়। শিল্প খাত বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প উল্লেখযোগ্য হলেও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তথ্য প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী শিল্প ও স্টার্টআপ খাতের বিস্তার সীমিত। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজ থাকলেও শিক্ষিত যুবকদের আকর্ষণ করে না।
জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি আরও চাপ সৃষ্টি করেছে। প্রতি বছর প্রায় ২.৫–৩ লাখ নতুন স্নাতক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ও চাকরির সৃষ্টি সমন্বিত নয়, ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। সরকারি ও বেসরকারি চাকরির সংখ্যা তরুণদের চাহিদা পূরণে সীমিত।
সরকারি নীতি ও পরিকল্পনার দুর্বলতাও উল্লেখযোগ্য। যুব উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ প্রকল্প, স্টার্টআপ সহায়তা প্রকল্প প্রায়শই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিতে ব্যর্থ হয়। প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম শিল্প খাতের চাহিদার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যকর প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান কেন্দ্রের অভাব আছে।
প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয়করণও বেকারত্ব বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। নতুন ডিজিটাল দক্ষতার চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষিত যুবকরা প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। সরকারি প্রশাসনিক ও ব্যাংকিং চাকরিতেও প্রবেশ সীমিত। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা যেমন, গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক সংযোগ বা রাজনৈতিক সমর্থনের প্রয়োজনও বেকারত্ব বাড়াচ্ছে।
তরুণ বেকারত্বের প্রভাব অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। উৎপাদন কমে যায়, আর্থিক উন্নয়ন ধীর হয়ে যায়। সামাজিকভাবে হতাশা, মানসিক চাপ, অপরাধ ও মাদকাসক্তি বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিকভাবে এটি দীর্ঘমেয়াদে অস্থিরতা ও অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে।
সমাধানের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ সংস্কার অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের জন্য প্র্যাকটিক্যাল ও প্রযুক্তিভিত্তিক কোর্স বাড়াতে হবে, ইন্টার্নশিপ ও বাস্তব অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে হবে। উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপ খাত উন্নয়নের মাধ্যমে স্ব-উদ্যোক্তা হিসেবে তরুণদের উৎসাহিত করতে হবে। সরকারী প্রশিক্ষণ ও চাকরির সংযোগ নিশ্চিত করতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কার্যকর কর্মসংস্থান কেন্দ্র স্থাপন জরুরি। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি, সামাজিক ও লিঙ্গভিত্তিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা হলে তরুণ বেকারত্ব হ্রাস সম্ভব।
বাংলাদেশের তরুণ বেকারত্ব একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো, সরকারি নীতি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ফল। তরুণ জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা সংস্কৃতি এবং সরকারি নীতির সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। তরুণদের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করলে শুধু বেকারত্ব কমবে না, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে।
এশিয়ানপোস্ট/আরজে