সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দ্বিদলীয় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবের এবং সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মস্ক। ৪ জুলাই দেশটির স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তিনি এক অনলাইন জরিপে জনগণের উদ্দেশ্যে এই বলে প্রশ্ন রাখেন, ‘স্বাধীনতা দিবস আপনাদের এটি জিজ্ঞেস করার প্রকৃত সময়, আপনারা কি দ্বিদলীয় সংস্কৃতি থেকে প্রকৃত স্বাধীনতা চান কি না’।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেল জরিপে অংশ নেয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ ইলন মাস্কের প্রস্তাবিত আমেরিকা পার্টির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় মাস্ক বলেন, ‘আপনাদের স্বাধীনতা দিতে আজ আমেরিকা পার্টি গঠিত হল।’
তবে মার্কিন ফেডারেল ইলেকশন কমিশনের নিবন্ধন ব্যতীত দলটির আনুষ্ঠানিকভাবে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ নেই, সেইসাথে এটাও ধারণা করা যায় যে, এই নিবন্ধন প্রক্রিয়াটিও একটি আনুষ্ঠানিকতার বিষয় এবং মাস্ক চাইলে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা খুব একটা কঠিন বিষয় হবে না।
তবে রাজনৈতিক দল গঠন করলেই যে মার্কিন রাজনীতিতে বিশেষ কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে, সে চিন্তা করা অবান্তর। দেশটির রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে যে চর্চা বিদ্যমান রয়েছে, এমন বাস্তবতায় তৃতীয় কোনো দলের উত্থান ঘটলেও তাদের নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের কোনো সুযোগ নেই। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৫৩৮টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। নির্বাচন ব্যবস্থাটিও এককথায় অদ্ভুত। কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গরাজ্যে যে দল বেশি ভোট পাবে, নির্ধারিত ইলেক্টোরাল কলেজের সবকটি ভোটই সে দলের পকেটে যাবে।
ধরা যাক, সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৫টি ইলেক্টোরাল কলেজ রয়েছে, মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে যদি কোনো প্রার্থী বিজয়ী হন, সবকটি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট তিনি পেয়ে যাবেন, আবার প্যানসিলভেনিয়ায় রয়েছে ২০টি ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট।
কোনো প্রার্থী যদি কয়েক লাখ ভোটের ব্যবধানেও বিজয়ী হন, তিনি নির্ধারিত ২০টিই পাবেন, এর বেশি নয়। এভাবে মোট ইলেক্টোরাল ভোটের কমপক্ষে ২৭০টি ভোটে নির্ধারিত হয় কে হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অনেক সময় দেখা যায় মোট ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে এগিয়ে থেকেও কেবল ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটের তারতম্যের জন্য কোন প্রার্থী পরাজিত হন। যেমনটা ২০০০ সালের নির্বাচনে হয়েছিল ডেমোক্র্যাট প্রার্থী আল গোরের ক্ষেত্রে এবং ২০১৬ সালের নির্বাচনে একই দলের হিলারি ক্লিনটনের ক্ষেত্রে।
রাজনৈতিক দল গঠন করলেই যে মার্কিন রাজনীতিতে বিশেষ কোনো সুবিধা পাওয়া যাবে, সে চিন্তা করা অবান্তর। দেশটির রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে যে চর্চা বিদ্যমান রয়েছে, এমন বাস্তবতায় তৃতীয় কোনো দলের উত্থান ঘটলেও তাদের নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের কোনো সুযোগ নেই।
এমন অবস্থায় নতুন কোনো দলের পক্ষে প্রচলিত দুই রাজনৈতিক দলের বাইরে গিয়ে কোনো নির্দিষ্ট অঙ্গরাজ্যে ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে জয়ী হলেও বাস্তবে ২৭০টি আসনে বিজয়ী হওয়ায় সুযোগ নেই। মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থা এমনিতেই খুব ব্যয়বহুল, এক্ষেত্রে পুরো দেশের নির্বাচনকে সামনে নিয়ে তৃণমূলকে সংগঠিত করে ভোট করে বিজয়ী হওয়া এককথায় অসম্ভব।
অন্যদিকে কোনো নির্দিষ্ট রাজ্যে তৃতীয় দলের ইলেক্টোরাল কলেজের নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোট প্রাপ্তি বিজয়ীদের জন্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এককথায় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের একঘরে হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে, কারণ এই বিজয় দিয়ে তারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সুবিধাই আদায় করতে পারবে না। তবে এখানে কথা থাকে যে, মার্কিন কংগ্রেস (প্রতিনিধি পরিষদ) এবং সিনেটে (প্রতি অঙ্গরাজ্যের জন্য সিনেটে ২টি করে আসন) নির্দলীয় প্রার্থীর বা তৃতীয় দলের প্রার্থীর জয়ের সুযোগ থাকতে পারে।
ইলন মাস্ক মূলত তার দল গঠনের মধ্য দিয়ে মার্কিন রাজনীতিতে এই বার্তার কথাই বলতে চাচ্ছেন যে, দ্বিদলীয় আধিপত্যের জায়গা থাকে তার দলের নির্বাচিত কংগ্রেস এবং সিনেটের সদস্যরা সরকারি বা বিরোধী দলের একচেটিয়া প্রভাবের জায়গা থেকে তাদের জন্য চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে আবির্ভূত হতে পারবে।
যেমন ধরা যাক, ট্রাম্পের ‘এ বিগ বিউটিফুল বিল’ নামে যে বিলটি সম্প্রতি পাস হলো, সেটি কংগ্রেসে ২১৮-২১৪ ভোটে এবং সিনেটে সমান সংখ্যক ভোটে টাই হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের ভোটে মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। এক্ষেত্রে যদি ভবিষ্যতে মাস্কের দলের একাধিক সদস্য কংগ্রেস বা সিনেটে থাকেন, তাহলে এটি একটি নির্ধারকের ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা একটা সম্ভাবনার বিষয় মাত্র, তবে এর বাইরে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের আসলে খুব একটা কিছু করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে মাস্ক যেভাবে দ্বিদলের আধিপত্য থেকে জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতার কথা বলছেন তা আসলে ভিত্তিহীন।
এক্ষেত্রে আমরা আরও উল্লেখ করতে পারি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু ডেমোক্র্যাটিক এবং রিপাবলিকান দলের বাইরে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল রয়েছে যেমন, লিবার্টিরিয়ান পার্টি, গ্রিন পার্টি, পিপলস পার্টি, ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টি ইত্যাদি। ২০২২ সালে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান পার্টির কয়েকডজন নেতা ফরোয়ার্ড পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করলেও পুরো দেশব্যাপী তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালানোর সীমাবদ্ধতার কারণে আর এগোতে পারেনি।
অতীতের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচন করলেও নির্বাচনী ব্যবস্থার বিদ্যমান নিয়মের কারণে তাদের পক্ষে কোনো ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করা সম্ভব হয়নি। রস পেরো নামের মার্কিন এক ধনকুবের একবার নির্বাচন করে ১৯ শতাংশ ভোট পেলেও কোনো ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট তিনি পাননি।
মাস্কের ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য রকম সমস্যাও রয়েছে, আর তা হচ্ছে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক না হওয়ার কারণে মার্কিন সংবিধান মোতাবেক তিনি কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, তবে তিনি কেন নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ভাবছেন? কারণ একটাই, জনগণকে তার ট্রাম্পবিরোধী মনোভাবের ব্যাখ্যা দেওয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প এধরনের তৎপরতাকে হাস্যকর বলে অভিহিত করে তাকে ‘লাইনচ্যুত ট্রেন’ বলে ব্যাঙ্গ করেছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিছুদিন আগ পর্যন্ত ট্রাম্পের অতি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে কাজ করা মাস্ককে কেন হঠাৎ নতুন করে রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে যেতে হলো। বিগত নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করতে ব্যক্তি হিসেবে সবচেয় বড় অঙ্কের অর্থ সহায়তা ২৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন মাস্ক, সেই সাথে ট্রাম্পের অনেকগুলো প্রচারাভিযানে তার সক্রিয় উপস্থিতি দেখা গেছে।
এককথায় বলা যায় ট্রাম্পকে নির্বাচনে বিজয়ী করতে একদম আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। বিজয়ী হয়ে ট্রাম্পের আরও ঘনিষ্ঠ হন। ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাকে হতাশ করেননি। দায়িত্ব দিয়েছিলেন সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) প্রধান হিসেবে, যেখানে তার দায়িত্ব ছিল অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয়ের উৎস খুঁজে বের করে ভর্তুকি কমানো।
সমস্যা মূলত এখান থেকেই। স্বার্থের দ্বন্দ্ব বলা যায় এককথায়। ট্রাম্প তার পরিকল্পিত ‘এ বিগ বিউটিফুল বিল’ উত্থাপনের প্রস্তুতি নিলে এতে বাধ সাধেন মাস্ক। মাস্কের পক্ষ থেকে এই বিলের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে এবং ইতিমধ্যে ডিওজিই-র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে গেছেন, এর সাথে বৈপরীত্য সৃষ্টি করবে বলে জানানো হলেও ট্রাম্প তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ট্রাম্প সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য যে নীতিগত কারণে মাস্ক বিদায় নিয়েছেন বলে জানানো হয়েছে তা অস্বীকার করে এখনে মাস্কের ব্যক্তিগত স্বার্থের সাথে এই বিলের সংঘাত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিলের মাধ্যমে অতিদরিদ্র মানুষের কর ছাড়ের বিষয় রয়েছে, রয়েছে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী মার্কিনীদের জন্য আরও বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা, যা নিঃসন্দেহে একটি ভালো ব্যবস্থা, এটি নিয়ে সরাসরি কোনো আপত্তি না থাকলেও একটি বড় অঙ্কের বরাদ্দ রয়েছে অবৈধ মার্কিন অভিবাসীদের বিতারণের জন্য, যা অর্থের অংকে ৪৫ বিলিয়ন ডলার, সাথে আরও আনুষঙ্গিক ১৪ বিলিয়ন ডলার, সেই সাথে রয়েছে মেক্সিকো সীমান্তে প্রতিরক্ষা কাঠামো নির্মাণের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলার।
মাস্কের ক্ষেত্রে অবশ্য অন্য রকম সমস্যাও রয়েছে, আর তা হচ্ছে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক না হওয়ার কারণে মার্কিন সংবিধান মোতাবেক তিনি কখনো প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হতে পারবেন না।
তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, সবুজ জ্বালানি বাবদ করছাড়, যা বাইডেনের সময়ে চালু ছিল তা বাতিল করেছেন ট্রাম্প। আর এখানেই মাস্কের সাথে স্বার্থের বড় সংঘাতটি হয়েছে ট্রাম্পের। এর ফলে মাস্কের টেসলা কোম্পানির কর অনেকগুণ বেড়ে যাবে। একইসাথে ট্রাম্প এটাও স্বীকার করেছেন যে, মাস্কের সুপারিশে নাসার প্রধান হিসেবে তিনি যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, সেক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত ঘটেছে বিবেচনা করে এই নিয়োগটি তিনি বাতিল করেছেন, যা মাস্কের স্পেসএক্সে মাস্কের স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করেছে। ট্রাম্প এই হুমকিও দিয়ে রেখেছেন যে মাস্কের টেসলা এবং স্পেসএক্স এতদিন ধরে যে করছাড় ভোগ করে আসছে তা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়া হতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র বিশ্বের অপরাপর দেশগুলোর গণতন্ত্রের তুলনায় উন্নত, এ বিষয়ে খুব একটা দ্বিমত নেই। দেশটির দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ভোটগ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরেই রয়েছে চরম নাটকীয়তা এবং একইসাথে জবাবদিহিতার সংমিশ্রণ। তাই এত সমালোচনার পরও দেশটির গণতন্ত্র এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা টিকে আছে।
মাস্ক এই ব্যবস্থারই একজন সুফলভোগী হয়ে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। আজ তার নতুন দল গঠনের এই উপলব্ধি তাই কেবলই স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত। এর জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগ তার জন্য কোনো বিষয় নয়, তবে এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তনে তিনি কোনো ভূমিকাই রাখতে পারবেন না।
ড. ফরিদুল আলম : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এশিয়ান পোস্ট/আরজে