মো. মাজহারুল ইসলামঃ
ফেমিনিজম ও ক্রিমিনোলজি উভয়ই নারী ও শিশুদের অপরাধের শিকার হওয়ার ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে, তবে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। Radical feminist স্কলাররা যেমন Andrea Dworkin ও Catharine MacKinnon বলেছেন, পুরুষদের দ্বারা নারীর ওপর সহিংসতা একটি কাঠামোগত বিষয়, এটি কেবল ব্যক্তিগত আচরণ নয়। তারা মনে করেন, যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণ হলো পুরুষদের ক্ষমতা প্রদর্শনের এক মাধ্যম।
লিঙ্গ ও শ্রেণি উভয়ই নারী নির্যাতনের কারণ। Heidi Hartmann বলেন, পিতৃতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একসাথে নারীদের অধীনস্থ রাখে। অর্থনৈতিক নির্ভরতা নারী ও শিশুদের দুর্বল করে তোলে।
Kimberlé Crenshaw–এর তত্ত্ব অনুযায়ী, নারী ও শিশুদের অভিজ্ঞতা শুধু লিঙ্গ নয় বরং জাতি, শ্রেণি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদির সংযোগে তৈরি হয়। ক্রিমিনোলজি অপরাধ ও অপরাধীর আচরণ বিশ্লেষণ করে। এখানে নারী ও শিশু নির্যাতনের কারণ হিসেবে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে।
Routine Activity Theory (Cohen & Felson, 1979) এই তত্ত্ব অনুসারে, অপরাধ তখনই ঘটে যখন একজন অপরাধী প্রস্তুত থাকে, উপযুক্ত টার্গেট থাকে (যেমন নারী/শিশু) এবং ‘গার্ডিয়ান’ বা সুরক্ষাকারী থাকে না। নারী ও শিশুরা অনেক সময় একা থাকে বা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় থাকে—ফলে সহজে টার্গেটে পরিণত হয়।
Social Learning Theory (Albert Bandura)-এর এই তত্ত্বে বলা হয়, অপরাধী সহিংসতা শেখে সমাজ ও পরিবার থেকে। যদি পুরুষ দেখে যে, নারীর ওপর সহিংসতা মেনে নেওয়া হয়, সে তখন তা ‘স্বাভাবিক’ ধরে নেয়। Strain Theory (Robert K. Merton) বলছে, সমাজে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথ যদি বন্ধ থাকে, তবে মানুষ বিকল্প (প্রায়ই অপরাধমূলক) পথ বেছে নেয়। অর্থনৈতিক বা মানসিক চাপ থেকে অনেকে শিশু পাচার, গার্হস্থ্য নির্যাতনের পথে যেতে পারে।
Liz Kelly (1988)—‘Continuum of Sexual Violence’ ধারণা দেন। সেই ধারণা বলছে, নারীরা জীবনে বিভিন্ন ধাপে যৌন সহিংসতার শিকার হন, এটি বিচ্ছিন্ন নয়। Carol Smart—নারীর অভিজ্ঞতাকে আইনি কাঠামোতে ঢোকাতে গেলে অনেক সময় তা বিকৃত বা উপেক্ষিত হয় বলে সমালোচনা করেন। Sandra Walklate বলেন, অপরাধ বিজ্ঞানে পুরুষ অভিজ্ঞতাকে সাধারণ হিসেবে ধরা হয়, নারীর ভিন্ন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে নারী ও শিশুদের অপরাধের শিকার হওয়ার ঘটনা একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যা বিভিন্ন কারণে ঘটে এবং এর পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স পরিসংখ্যান ২০২৪, যুক্তরাষ্ট্র তথ্য অনুসারে, প্রায় ৮৫ শতাংশ নারী ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হন।
২০২২ সালে প্রায় ১,৭৬২,৮৪০ নারী সহিংস অপরাধের শিকার হয়েছেন, যা পুরুষদের চেয়ে সামান্য বেশি। দ্য স্কটিশ সান, ১৩ মার্চ ২০২৫ এর রিপোর্ট অনুসারে, প্রতি বছর ৩ লাখ নারী ক্রীতদাসী হিসেবে শিকার করা হয়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় ক্রীড়া ইভেন্টের সময়।
২৭ মে ২০২৪ দ্য গার্ডিয়ান-এর রিপোর্ট বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪,৪৩,৯৯০জন শিশু সহিংস অপরাধের শিকার হয় এবং প্রতি বছর ৩০০ মিলিয়ন শিশু অনলাইন যৌন নিপীড়নের শিকার হন, যার মধ্যে ১৪ মিলিয়ন মার্কিন পুরুষ এ ধরনের অপরাধে জড়িত।
সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অপরাধীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অনলাইন যৌন নিপীড়ন ও ‘সেক্সটরশন (Sextortion)’-এ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকরে রক্ষা পায়। যেমন Kelly Savage-Rodriguez নামের এক নারী ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হয়েও ‘failure to protect’ আইনে দোষী সাব্যস্ত হন।
EL PAIS ENGLISH, ২৫ নভেম্বর ২০২৩, তথ্য অনুসারে ২০২৩ সালে মেক্সিকোতে মোট ৮২৭ নারী হত্যাকাণ্ডকে ফেমিসাইড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, ২০২২ সালে ৩,৭৫৭ নারী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ২,৮৪১ জন নারী নিখোঁজ ছিলেন এবং প্রতি বছর গড়ে ১০ থেকে ১১ জন নারী মেক্সিকোতে হত্যা হন।
২০২২ সালে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে ৪,১৯৭টি ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে, যা ছেলেদের তুলনায় প্রায় চারগুণ বেশি। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী মেয়েরা প্রায় তিনগুণ বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হন ছেলেদের তুলনায়।
ব্রাজিলের অনেক এলাকায় এখনো পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা প্রবল। নারীদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হয়, যা তাদের প্রতি সহিংসতা বা অবমূল্যায়নকে সামাজিকভাবে অনেক সময় বৈধতা দেয়। গৃহসহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনের হার অত্যন্ত উচ্চ। অনেক সময় নারী ও শিশুদের নির্যাতনকারীরা পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজনই হয়ে থাকে।
ভিকটিমরা নানা কারণে (ভয়, সামাজিক লজ্জা, সঠিক বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা) অভিযোগ করে না। দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাগুলোয় নারী ও শিশুরা অপরাধের সহজ লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তারা পাচার, শিশু শ্রম, যৌন শোষণ ইত্যাদি অপরাধে জড়ানোর বা ভিকটিম হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
যদিও ব্রাজিলে নারী ও শিশু সুরক্ষায় কিছু আইন রয়েছে (যেমন মারিয়া দ্য পেন্থা আইন), আইন প্রয়োগের দুর্বলতা এবং বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি অপরাধীদের উৎসাহ দেয়। গ্যাং ও মাদক চক্রগুলো নারী ও শিশুদের নিজেদের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে—যেমন ড্রাগ বহন, যৌন পাচার ইত্যাদির জন্য। অনেক সময় তারা জোরপূর্বক বা প্রতারণার মাধ্যমে এই কাজগুলো করায়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সাব-সাহারা আফ্রিকায় ৭৯ মিলিয়নেরও বেশি নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, ২০২১-২২ সালে, ৩,১৯৮ জন নারী ও ১,০৮২ জন শিশু খুন হয়েছেন Africa Check-এর রিপোর্ট অনুসারে। সুদানে, ২০২৪ সালের শুরু থেকে ২০০-এরও বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে এক বছরের শিশুও রয়েছে।
গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রকে ‘বিশ্বের ধর্ষণের রাজধানী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়, যেখানে সংঘাতকালে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা ব্যাপকভাবে ঘটে। অনেক আফ্রিকান সমাজে নারীরা পুরুষের তুলনায় কম মর্যাদা পান, ফলে তারা সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হন। সুদান, কঙ্গো, নাইজেরিয়া প্রভৃতি দেশে চলমান সংঘাতে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ-অপহরণে নারী ও শিশুরা ব্যবহৃত হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ান, ২৫ নভেম্বর ২০২৪ তথ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি সদস্য দেশে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারী শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যার মধ্যে এক-চতুর্থাংশ নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন এবং প্রায় ১৯ শতাংশ নারী পারিবারিক সদস্যদের কাছ থেকে সহিংসতা বা হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন।
২০২৩ সালে ফ্রান্সে ৯৬ জন নারী ‘কনজুগাল ফেমিসাইড’-এর শিকার হয়েছেন। স্পেনে ২০২৪ সালে ৪৮ জন নারী ‘জেন্ডার ভায়োলেন্স’-এর কারণে নিহত হয়েছেন। ইতালিতে ২০২৪ সালে ৯০টিরও বেশি ফেমিসাইডের ঘটনা ঘটেছে। বিবিসি নিউজ, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ রিপোর্ট অনুসারে, ইউনাইটেড কিংডমে (যুক্তরাজ্য) ২০২৩ সালে ১৫৪ জন নারী ও শিশুদের একটি গ্যাং দ্বারা বড় আকারে শপলিফটিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। এই গ্যাংটি স্কটল্যান্ড থেকে শুরু করে লন্ডন, ম্যানচেস্টার ও অন্যান্য শহরে সক্রিয় ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে ৯ নভেম্বর ২০২৪, দ্য গার্ডিয়ান তথ্য অনুসারে, জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় নিহতদের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী ও শিশু। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮,১১৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৩,৫৮৮ জন শিশু ও ২,০৩৬ জন নারী।
ইউনিসেফ ইরাক, ১২ ডিসেম্বর ২০২১ এর রিপোর্টে বলে প্রায় ১.৩২ মিলিয়ন নারী ও কিশোরী বিভিন্ন ধরনের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে, যার মধ্যে ৭৭ শতাংশ ঘটনা গৃহস্থালি সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
দ্য ন্যাশনাল পত্রিকা বলছে, সংযুক্ত আরব-আমিরাত (UAE)-তে ২০১৮ সালে ৯৫৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৮৯৩টি গৃহস্থালি সহিংসতা, ১০০টি শিশু নির্যাতন এবং ৩৩ শতাংশ ভিকটিম ছিলেন আরব-আমিরাতের নারী বা শিশু।
বিভিন্ন দেশে নারী ও শিশুদের অপরাধের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কারণসমূহগুলো প্রধানত লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য, যুদ্ধ ও সংঘাত, মানব পাচার ও অপরাধমূলক গ্যাং, শিশু শ্রম ও অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার, আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও তথ্যের অভাব, দারিদ্র্য ও শিক্ষা অভাব এবং গৃহসহিংসতা ও যৌন নির্যাতন।
মো. মাজহারুল ইসলাম ।। সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
এশিয়ান পোস্ট/আরজে