রফিকুল ইসলাম রাজুঃ
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফ-৭ প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা শুধু আতঙ্কই নয়, বরং আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা ও বেসামরিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গভীর ভাবনার জায়গা তৈরি করেছে। দিনের আলোয় হাজারো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের উপস্থিতির মধ্যে এ ধরনের ঘটনা অল্পের জন্য বড় মাপের প্রাণহানি থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই নগরীর আকাশে যুদ্ধবিমানের মহড়া বা প্রশিক্ষণ কতটা যৌক্তিক ও নিরাপদ?
ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর। একটি প্রশিক্ষণ বিমান শহরের উপর দিয়ে উড়বে, তা যেন একপ্রকার ‘চাকু হাতে ছুরি খেলার মতোই’ অবস্থা। আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান চালনার জন্য জনবসতি থেকে দূরে নির্ধারিত এয়ার জোন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমাদের এখানে ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায়। ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ডের ব্যবধানে অন্যরকম কিছু ঘটে যেতে পারত—একটি স্কুলে কিংবা আবাসিক এলাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা অমূলক নয়।
আরও দুঃখজনক হচ্ছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হাতে থাকা চীনে তৈরি এফ-৭ বিমানগুলোর বয়স ও দুর্বলতা। একটি আধুনিক সামরিক বাহিনীর জন্য ৬৫ বছরের পুরনো মডেলের যুদ্ধবিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এসব বিমান আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আজ আর কার্যকর নয়, বরং ঝুঁকিপূর্ণ।
এফ-৭ আসলে চীনের তৈরি একটি যুদ্ধবিমান, যা মূলত রাশিয়ার মিগ-২১ এর সংস্করণ। এই বিমানগুলো উচ্চ গতির হলেও প্রযুক্তিগতভাবে আজ অনেকটাই পরিত্যক্ত। উন্নত দেশগুলো এ ধরনের যুদ্ধবিমান অনেক আগেই বহিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হাতে থাকা বেশিরভাগ এফ-৭ এর বয়স প্রায় ৩ দশক। অব্যাহত যান্ত্রিক ত্রুটি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা এসব বিমানের ওপর আস্থা রাখাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ৩২টি বড় দুর্ঘটনা
বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ চলাকালেই ঘটে, যা পিটি-৬, ইয়াক-১৩০, এল-৩৯ বা এফ-৭ টাইপ বিমানের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে। প্রায় প্রতি দশকেই ফ্লাইট ক্যাডেট এবং স্কোয়াড্রন লিডারদের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি — একদিনেই ৪৪টি বিমান বিধ্বস্ত হয়। উত্তরার দুর্ঘটনা এ তালিকায় বিরল ও ভয়াবহ সংযোজন, যেখানে যুদ্ধবিমান সরাসরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হয়ে এতজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১৯৯১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সকল বড় বিমান দুর্ঘটনার তালিকা তুলে ধরা হলো, যেখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কিংবা প্রাণহানি ঘটেছে—
৯ মে ২০২৪ – ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান, কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত; স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ নিহত
২৩ নভেম্বর ২০১৮ – এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান, টাঙ্গাইলে রকেট ফায়ারিং অনুশীলনের সময় বিধ্বস্ত, পাইলট নিহত
১ জুলাই ২০১৮ – কে-৮ডব্লিউ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত, দুই পাইলট নিহত
২ জানুয়ারি ২০১৮ – মিল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, শ্রীমঙ্গলে বিধ্বস্ত, কুয়েতি সামরিক কর্মকর্তা-সহ
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ – দুইটি ইয়াক-১৩০ কক্সবাজারে বিধ্বস্ত
১১ জুলাই ২০১৭ – ইয়াক-১৩০ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বিধ্বস্ত, পাইলটরা ইজেক্ট করেন
২১ জুলাই ২০১৫ – এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার, মিরসরাইয়ে জরুরি অবতরণকালে ক্ষতিগ্রস্ত
২৯ জুন ২০১৫ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, পতেঙ্গা উপকূলে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট তাহমিদ নিহত
১৩ মে ২০১৫ – এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার, শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত, ১ প্রশিক্ষক নিহত
৩০ এপ্রিল ২০১৪ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত
২০ মে ২০১৩ – এল-৩৯ প্রশিক্ষণ বিমান, যশোরে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে
১৪ জুলাই ২০১৩ – ন্যাঞ্ছাং এ-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত
৮ এপ্রিল ২০১২ – এল-৩৯ অ্যালবাট্রস জেট ট্রেনার, মধুপুরে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট রেজা শরীফ নিহত
২০ ডিসেম্বর ২০১০ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান, বরিশালে বিধ্বস্ত, দুই স্কোয়াড্রন লিডার নিহত
২০১০ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, পতেঙ্গায় বিধ্বস্ত
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান, কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত
২২ অক্টোবর ২০০৯ – পিটি-৬ ট্রেনার বিমান, বগুড়া সদরে বিধ্বস্ত
১৬ জুন ২০০৯ – এফটি-৬ যুদ্ধবিমান, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত
৮ এপ্রিল ২০০৮ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, টাঙ্গাইলের পাহাড়িয়া গ্রামে বিধ্বস্ত, স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ নিহত
৯ এপ্রিল ২০০৭ – পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান, যশোরে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট ক্যাডেট ফয়সাল মাহমুদ নিহত
২৪ এপ্রিল ২০০৬ – পিটি-৬, কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট ক্যাডেট তানজুল ইসলাম নিহত
৭ জুন ২০০৫ – এফ-৭এমবি যুদ্ধবিমান, উত্তরায় বহুতল ভবনের সঙ্গে সংঘর্ষ
৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত
২০০৩ – পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত
১৫ নভেম্বর ২০০৩ – পাইপার সেসনা এস-২ বিমান বিধ্বস্ত
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ – এফটি-৭বি বিমান বিধ্বস্ত
১৯ অক্টোবর ২০০২ – এমআই-১৭-২০০ হেলিকপ্টার, কক্সবাজার উখিয়ায় বিধ্বস্ত, ৪ জন নিহত
৩০ জুলাই ২০০২ – এ-৫সি যুদ্ধবিমান, চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট আদনান নিহত
৭ জানুয়ারি ২০০১ – এফটি-৭বি ট্রেনার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মহসিন নিহত
১৭ নভেম্বর ১৯৯৮ – ন্যাঞ্ছাং এ-৫সি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত
২৬ অক্টোবর ১৯৯৮ – এফ-৭এমবি বিধ্বস্ত
৮ মে ১৯৯৬ – একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত
১৯৯৪ – একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত
১৯৯৩ – দুটি পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান সংঘর্ষ, তিন পাইলট নিহত
১৯৯৩ – একটি এফটি-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট কুদ্দুস নিহত
৩০ এপ্রিল ১৯৯১ – ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৪০টি এফ-৬ এবং ৪টি মিল-৮ হেলিকপ্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস
সূত্র- ইত্তেফাক, ২১ জুলাই ২০২৫
প্রশ্ন ওঠে, এসব দুর্ঘটনা থেকে আমরা কী শিখেছি?
বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করে না। তবে সেই প্রশিক্ষণ যেন এমন স্থানে ও এমন প্রযুক্তির মাধ্যমে হয়, যা জনগণের নিরাপত্তাকে অগ্রাহ্য করে না। প্রয়োজন হলে নির্জন এলাকায় আলাদা প্রশিক্ষণ ঘাঁটি তৈরি করতে হবে, যেন রাজধানীর মতো জায়গা এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার না হয়।
সরকারের পক্ষ থেকে দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে—এটা স্বস্তির বিষয়। তবে প্রতিবেদন যেন শুধুই “দায়সারা তদন্ত” না হয়, বরং এ থেকে বাস্তব পরিবর্তনের পদক্ষেপ শুরু হয়।
বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল সামরিক কাঠামো গড়তে হলে যুদ্ধবিমান আধুনিকীকরণ, বিমান রক্ষণাবেক্ষণের মান উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় নেওয়া সময়ের দাবি। আমাদের আকাশ শুধু সামরিক মহড়ার জন্য নয়—এটা জনগণেরও আকাশ। সেই আকাশ নিরাপদ রাখতে আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক