এই উপমহাদেশে সাড়ে ছয়টার পরেই রাত নেমে আসে।অনুন্নত জীবনধারা,পরিশ্রমী মানুষগুলো খুব দ্রুত ই ঘুমিয়ে পড়ে।ক্লান্ত শরীরে ঘুমের স্বস্তি আর চোখ বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই যদি ঘুম ভেঙে যায় তো মানসিক আর শারীরিক অস্বস্তি বিরাজ করে আর যদি জানা যায় যে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে! তাহলে তো মনের শান্তি এবং জীবনের নিরাপদ সব ই শেষ।
হ্যাঁ,বুধবারের তারিখ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ভারত আক্রমণ করে বসলো পাকিস্তানকে।পাকিস্তানের নয়টি (ভারতের মতে সন্ত্রাসী এলাকা) এলাকায় তারা বিমান হামলা চালায় ইউক্রেন-রাশিয়া,ফিলিস্তিন-ইজরাইল যুদ্ধ ছাপিয়ে বিশ্ব জুড়ে এখন ভারত-পাকিস্থান ইস্যু।এখানে যুদ্ধ হওয়া মানে মৃত্যু এবং অসংখ্য মানুষের রক্ত ও লাশের উপরে লেখা থাকবে যুদ্ধের নতুন ইতিহাস।
গত ২২ এপ্রিল ভারতের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলার জেরে পাল্টাপাল্টি উত্তেজনার মধ্যে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় পাকিস্তানে দুই শিশুসহ আটজন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়েছেন। বুধবার (৭ মে) ভোরে সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ভারতের হামলায় একটি মসজিদসহ একাধিক স্থানে আঘাত হেনেছে। ‘এটি আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’।আইএসপিআরের মহাপরিচালক জানান, মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতের পর পাকিস্তানের কোটলি, ভাওয়ালপুর, মুরিদকে, বাগ ও মুজাফ্ফরবাদে ‘কাপুরুষোচিত’ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ভারত। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এরইমধ্যে এর বদলা নিতে শুরু করেছে।গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির পর থেকে পারমাণবিক ক্ষমতাধর দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এ হামলা চালাল ভারত।
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে পাকিস্তান পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের আইএসপিআর। এরমধ্যে প্রতিরক্ষা সূত্রের বরাতে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও টিভি জানিয়েছে, ভারতের দুটি বিমান ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী।
এদিকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী নিশ্চিত করেছে যে তারা ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর অংশ হিসেবে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের ৯টি স্থান লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। রবি ঠাকুরের মতে,” বহুদিন ধরে,বহু ক্রোশ দূরে,বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে,দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু,
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,ঘর হতে দু’পা ফেলিয়া একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু।” ভারত যে এই অপারেশন নাম দিয়েছে সিন্ধু সেখানে হয়তো তারা একটুও বুঝে উঠতে পারে নি যে এত কত রক্ত,কত লাশ আর কত ক্ষয়ক্ষতি হবে; হয়তো রবি ঠাকুরের দেশে শিশির নয়,রক্ত ই দেখবে সবাই।যুদ্ধ যখন কেউ করে তখন সকলেই বলে ” জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার স্বার্থে এ যুদ্ধ ” অথচ মরে তো এই জনগণ ই তা ভারতের হোক আর পাকিস্তানের। বুধবারের হঠাৎ হামলায় বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত এবং এক অনাগত আতঙ্কে ভুগছে সবাই কারণ উভয় দেশের হাতেই আছে মানব সমাজ ধ্বংসকারী পারমাণবিক বোমা!ইতোমধ্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ খান এক বিবৃতিতে বলেছেন “শত্রুরা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পাঁচটি জায়গায় এক কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালিয়েছে। এই আগ্রাসনের ঘটনা ছেড়ে দেওয়া হবে না।বিনা প্ররোচনায় ভারতের এই হামলার চূড়ান্ত জবাব দেওয়ার পূর্ণ অধিকার পাকিস্তানের রয়েছে।” যদিও ভারত এবং বিচ্ছিন্নভাবে কিছু মিডিয়া বলছে পাঁচটি নয় বরং পাকিস্তানের নয়টি স্থানে ভারত হামলা করেছে এবং শিশুসহ সাতজন নিহত ও একটি মসজিদ পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে।
ইতোমধ্যে ভারতের এই ন্যক্কারজনক ও কাপুরুষোচিত আচরণে বিশ্বে নিন্দার ঝড় বইছে।জাতিসংঘসহ,যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিন্দা বার্তা দিয়েছেন।ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাস জানিয়েছে, হামলার পর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব মার্কো রুবিওর সঙ্গে কথা বলেছেন।
পরে হোয়াইট হাউজে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই অভিযানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন, “এটা লজ্জর ঘটনা”। হোয়াইট হাউজে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমি শুধু চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সংঘাত শেষ হোক।” জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, নিয়ন্ত্রণ রেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে ভারতের সামরিক অভিযানে তিনি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”তিনি বলেছেন, “মহাসচিব দুই দেশকেই সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানের আরও একটি সামরিক সংঘাতের ভার বিশ্ব বহন করতে পারবে না।”
জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সবসময়ই প্রশ্নবিদ্ধ কারণ তারা নিন্দা এবং উসকানি ছাড়া আজও কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারেনি।সাত দশকের ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান আসেনি,ছয় দশক ধরে চলা কাশ্মীর সমস্যার আজও কিছু হয়নি বরং দেশে দেশে আরও যুদ্ধ বেঁধেছে আর সাধারণ মানুষ মৃত্যুকে, ধ্বংসকে আলিঙ্গন করেছে।বিশ্বের সকল দেশের যুদ্ধের চেয়ে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের ক্ষতির মাত্রা হবে ভয়ানক কারণ এখানে দুই দেশের সাথে প্রায় দুইশো কোটি মানুষের জীবনের প্রশ্ন আছে আর সেই প্রশ্নের সমাধানে কেউ যদি পারমাণবিক বোমা ফেলে তো বিশ্বের আটশো কোটি মানুষের দুইশো কোটিই শেষ! ভারতের একশো বিয়াল্লিশ কোটি জনগণ আর পাকিস্তানের হলো মাত্র পঁচিশ কোটি!কিন্তু যুদ্ধে, বোমায় তো এই মানুষগুলো ই মরবে!
সুতরাং, আমি কারও সমর শক্তি নিয়ে ভাবছি না,কে হারবে,কে জিতবে -তা আমার উদ্বিগ্নতার কারণ নয় বরং এই বিশাল জনগণ ও মানুষের জীবন হারবে,মানুষ ই মরবে।তাই বলি,” যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়,যুদ্ধ হলো মানব সমাজের লয়।” যুদ্ধবাজ মোদী সরকার এই উপমহাদেশে দাদা গিরি করতে গিয়ে ক্রমেই একা হয়ে পড়ছে এবং এই একাকিত্ব ই হয়তো তাকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে।পাকিস্তানের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিতে মোদী সরকারের এত বড় রিস্ক নেওয়া – যুদ্ধ বা সমর শাস্ত্রেও ঠিক হয়নি।
বুধাবারের এ হামলায় প্রত্যক্ষদর্শীরা বিবিসিকে পাকিস্তানের মুজাফফরাবাদের বাসিন্দা শাহনওয়াজ বলেন, ‘আমরা তখন বাড়িতে গভীর ঘুমের মধ্যে ছিলাম, বিস্ফোরণের শব্দে আমরা কেঁপে উঠি।” এখন আমরা আমাদের পরিবার, নারী ও শিশুদের নিয়ে কোনও একটা নিরাপদ স্থানের খোঁজে ঘুরছি।”শহরে আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে, আরও হামলার আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
মুজাফফরাবাদের বিলাল মসজিদের পাশে যেখানে ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে, সেখানকার এক বাসিন্দা মোহাম্মদ ওয়াহিদ বলেন, “প্রথম বিস্ফোরণে আমার বাড়ি যখন কেঁপে ওঠে, তখন আমি গভীর ঘুমের মধ্যে ছিলাম।”
গত ২২ শে এপ্রিল পহেলগাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত বৈসারণে পর্যটন স্পটে বন্দুকধারীদের হামলায় মােট ২৬জন নিহত এবং ১৭জন আহত হয়েছিলেন।আর তারপর থেকেই দু’দেশে উত্তেজনা বাড়ছে।ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মানে বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে তুমুল যুদ্ধ চলে।এ যুদ্ধে আবার হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের ভেতর উত্তেজনা বাড়ে।ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া গরম হতে শুরু করেছে।পক্ষে-বিপক্ষে চলছে শাব্দিক আক্রমণ এবং চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সমর শক্তির পর্যালোচনা।
কিন্তু আমরা যারা শান্তি প্রিয় মানুষ তারা সমর শক্তি নিয়ে নয় বরং এ অঞ্চলের মানুষের জীবন ও মালের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধে কেউ হারবে না,হারবে এ অঞ্চলের বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবন ও স্বপ্ন।বাংলা একটা গান আছে,” ডাকে পাখি,খোল আঁখি দেখ সোনালি আকাশ” কিন্তু আজ আর সোনালি আকাশ দেখতে পাই নি বরং আকাশে যুদ্ধ বিমান,ফেসবুকের আকাশের যুদ্ধের বার্তা আর ভারত-পাকিস্তানের মানুষের জীবনের কষ্ট।আমরা এ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি চাই। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ” যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা,যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা।”
লেখক-মামুনার রশীদ
এশিয়ান পোস্ট/আরআর