রোববার,১৫ জুন; প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বাবা দিবস।আজকের এই মহান দিনে পিতৃতুল্য সকল বাবাকে এবং আমার বাবাকে ভক্তিপূর্ণ ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা জানাই। বাংলাদেশের কিংবদন্তি নায়ক আলমগীর ও বাংলার মহা নায়িকা শাবানা অভিনীত সত্য মিথ্যা সিনেমাতে শিল্পী শাম্মী আক্তারের গাওয়া একটা গান আপনাদের মনে আছে আছে হয়তো! গানের প্রথম দুই লাইন ছিল এমন,” মন্দ হোক,ভালো হোক,বাবা আমার বাবা,পৃথিবীতে বাবার মতো আর আছে কে বা।” সত্যি তাই।বাবার তুলনা কেবল বাবা ই।পৃথিবীতে যার বাবা নেই সে জানে বাবা কী ধন!
গত ১২ মে, মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ছিল বিশ্ব মা দিবস। বাবা দিবস পরে কেন? কিম্বা জুন মাসের তৃতীয় রোববার কেন? এমন প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল আর তখন মনে পড়লো রাসূলে কারীম সাঃ এর একটি হাদীস। হাদীসটি সহীহ্ বোখারী শরীফের (বাংলা) ৫৫৪৫ নং হাদীস। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ(রাঃ) বলেন,’ আমি একদা নবিজীকে জিজ্ঞেস করলাম,কোন কাজ আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়?’ তিনি বললেন,’ ওয়াক্ত মতো নামাজ আদায় করা। সেই সাহাবী আবার জিজ্ঞেস করলেন,’ তার পরে কোনটা?’ রাসূল জবাব দিলেন,’ পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা।’ তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,’ তার পরে কোনটি?’ রাসূল সাঃ জবাব দিলেন,’ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।”
হাদীসটি বিশ্লেষণ করা বা এর উপরে কিছু বলার জ্ঞান, ক্ষমতা বা দুঃসাহস আমার নেই। তিনটি কাজ ই আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।এখানে পিতা-মাতার কথা আলাদা করে বলা হয়নি কিন্তু আমরা এখন যে দিবস পালন করছি তা ‘মা’ আর “বাবা’ আলাদা করে কেন? একদিনেও হতে পারত! কিন্তু হলো না কেন! এটা মনে হয় বুঝে নিলাম ৫৫৪৬ নং হাদীস পড়ে। এই হাদীসটি বর্ণনা করেন হযরত আবু হুরায়রা রাঃ।তিনি বলেন,’ একদা জনৈক এক ব্যক্তি নবিজীর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলেন,” হে আল্লাহর রাসূল(সাঃ)! আমার কাছে সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যবহার পাওয়ার অধিকারী কে? রাসূল (সাঃ) বললেন,’ তোমার মা।’ তারপরে কে? তিনি উত্তরে আবারও বললেন,’ তোমার মা।তৃতীয়বারেও নবিজী একি উত্তর দিলেন আর চতুর্থবারের প্রশ্নে রাসূলে পাক সাঃ বললেন,’ তোমার পিতা’।
আজ ১৫ জুন।অর্ধেক বছরের সমান সমান দিন।আর আজ আমরা বিশ্বব্যাপী পালন করছি,’ বিশ্ব বাবা দিবস।তাও তৃতীয় রোববারে।বাবা দিবস তৃতীয় রোববার হোক আর দ্বিতীয় রোববার হোক – সন্তানের কাছে বাবার গুরুত্ব অপরিসীম।বাবাকে রোজ ভালোবাসি,শ্রদ্ধা করি।কিন্তু আজকের এ দিনে বাবাকে যেন বিশেষ কিছু দিয়ে খুশি করতে পারি সে জন্য ই এ লেখা। আমি আজ বাবা দিবসের প্রতিপাদ্য কী,বাবা দিবস কীভাবে, কখন আসলো – এগুলো নিয়ে কথা বলবো না কারণ এগুলো তথ্য সবার ফোনেই আছে। আমি বলবো আমার বাবার কথা, আর সকল বাবাকে করবো শ্রদ্ধা ও ভক্তি।
একটা মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।গত বৃহস্পতিবার দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নাম সাফিন তাকে পিতৃস্নেহ নিয়ে প্রশ্ন করলাম,’ তোমরা কয় ভাই-বোন? ‘ দুই’ ‘কে বড়?’ আমার এ প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,’ আমি’। এবার তাকে জিজ্ঞেস করলাম,’ আর বাবা?’ সে আবার যে উত্তর দিল তাতে সবার মুখে হাসি আসলো। সে বলল,’ বাবা তো বড় ই!’। আসলে আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম তোমার বাবা কী করেন! তোমার বাবা বেঁচে আছে কি না! কিন্তু সে বুঝেছে ভিন্ন আর সেই ভিন্ন প্রশ্নের উত্তর থেকেই আমার বাবার কথা আজ লেখার ইচ্ছা। বাবার ব্যাপারে কে কী বলল -তাতে বাবার কোনো মানের কম বেশি হয় না। বাবা সর্বদাই বড়,মহান এবং অতুলনীয়।আমার বাবার সাথে আমার আছে গভীর সখ্যতা।আমার বাবা স্বল্প শিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত,অক্ষর জ্ঞান সর্বস্ব।কিন্তু আমার বাবা আমার কাছে প্রথম জ্ঞানের দিকপাল। তিনিই প্রথম আমাকে পত্রিকা পড়া শেখান।তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।সারাদিন স্কুলে থেকে বিকেলে ছুটে যেতাম বাবার কাছে,তাঁর ব্যবসায় সাহায্য করতে। দোকানে গেলে তিনি দুই টাকার সেই ‘ আজ ও আগামীকাল’ যার সম্পাদক ছিলেন ডা.জাহিদ কামাল আমাকে রোজ পড়ে নিতেন। পড়ে পড়ে আমাকে শোনাতেন।সেই থেকে শুরু।বাবা এখন বয়সের কাছে হার মেনেছে।আজ ও আগামীকাল পত্রিকা আর বের হয় না,বাবা তেমন চোখেও দেখেন না তবে পত্রিকা ছাড়েননি।আজও হাতে দেখি তাঁর একখনকার বগুড়ার জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক করতোয়া।সেখানে আজ এই বাবা দিবসে তাঁকে নিয়ে লেখাটা উৎসর্গ করছি।পত্রিকা পাগল বাবা আমার।বাবার দামি কোনো বাড়ি-গাড়ি ছিল না কিন্তু আমার এসএসসি পাশের পরে থেকে আজও নিজে পত্রিকা রোজ কিনি, রোজ পড়ি।বাবার দেওয়া অভ্যাস আমাকে জ্ঞানের জগতের সাথে রোজ মিতালী গড়তে সাহায্য করে। আমার বাবা যদিও অন্ধ নন তবুও আজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো আক্ষেপ করে বলতে ইচ্ছে করে,
” বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন,দেখিস, একদিন আমরাও,,,,,,,,
বাবা এখন অন্ধ,আমাদের দেখা হয়নি কিছুই
সেই রয়্যাল গুলি,সেই লাঠি-লজেন্স,সেই রাস-উৎসব
আমায় কেউ ফিরিয়ে দিবে না।”
সত্যি,আমরা দারিদ্র্য পীড়িত মানুষ।বাবা সারাদিন কর্ম ব্যস্ত।দোকান ই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান।তাঁর সাথে কোথাও,কোনো উৎসবে আমার যাওয়া হয়নি।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়’ কিছুই দেখা হয়নি” তবু তিনি ছোট্ট দোকানে বসে পত্রিকার মাধ্যমে আমার জ্ঞানের জগতে যে বিশাল পরিচিতি এনেছেন -তা সত্যি অতুলনীয়।আজও আমি তেমন ভ্রমণ করি না তবে বাবার দেওয়া সেই সুন্দর অভ্যাসে করে পুরো পৃথিবী দেখি,পৃথিবীকে জানি।আমার দেখা গত ত্রিশ বছরে আমি বাবাকে কোথাও যাইতে দেখি নি,পাড়া-মহল্লায় ঘুরতে দেখি নি,কোনো চায়ের আড্ডায় দেখি নি তবে তখনো যা দেখেছি,এখনো দেখছি বাবার হাতে সেই পত্রিকা। এখন তিনি অসুস্থ, বেডে পড়ে আছেন। তবু পত্রিকা পড়া, খবর শোনা তাঁর অভ্যাস।বসে,শুয়ে নজর বুলিয়ে নিচ্ছেন।আর আমিও ফাঁকে ফাঁকে তাঁকে দেখে কবুল হজ্বের সওয়াব আদায় করছি।হাদীসে উল্লেখ আছে, যে নেক নজরে বাবা-মায়ের দিকে তাকালে কবুল হজ্বের সওয়াব পাওয়া যায়।এখন জিলহজ মাস এবং হজ্বও শেষ।আমার সাধ্য নেই বাবাকে হজ্ব করানোর বা নিজে হজ্ব করার তাই নেক নজর দেওয়ায় আমার একমাত্র দায়িত্ব!
বাংলার সুর সম্রাট বাউলখ্যাত শিল্পী জেমস এর একটা গানের লাইন ছিল এমন,’ ছেলে আমার বড় হবে,মাকে বলতো সে কথা
মানুষের মতো মানুষ হবে,লেখা ইতিহাসের পাতা”
আমার বাবা আমাকে বড় হতে বলেন নি,কোথাও যেতে বলেন নি শুধু বলেছিলেন,’ কাজ করে খাবি,কোথাও যাওয়া লাগবে না।মানুষকে ঠকাবি না।বড় হওয়ার দরকার নেই।’
মনে হয় বাবার দোয়া কবুল হয়েছে।আমি বেড়ে উঠেছি,পদ-পদবি বা বড় হইনি,বাহিরেও যাইনি।কাজ করেই খাই।আমি কাজের ছেলে।বাবাকে আজ বলতে ইচ্ছে করে, ‘ জানো বাবা,আমার পড়ার টেবিলে এখন দৈনিক প্রথম আলো,দৈনিক করতোয়া,ডেইলি স্টার,সাতমাথা পত্রিকা থাকে।’ আমি রোজ পড়ি আর শব্দে শব্দে তোমাকে স্মরণ করি। আমাকে তুমি লালন-পালন করেছো,বড় করেছো: হয়তো বংশ সূত্রে সম্পত্তি পাই নি তবে সম্পদ পেয়েছি।তোমার দেওয়া সুঅভ্যাস আমার চিরদিনের সম্পদ।এই জ্ঞানের সম্পদে আমি পরিভ্রমণ করবো সারাবিশ্ব।
পবিত্র হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে যে,সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার।সমগ্র সৃষ্টির ভেতর আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় সেই ব্যক্তি,যে তার নিজের পরিবারের প্রতি দয়ালু।” আর বাবাগণ হলেন সেই দয়ালু ব্যক্তি যাঁরা সারাদিন খেয়ে,না খেয়ে সংসারের জন্য সঞ্চয় করেন,লড়াই করেন।আজ এই বাবা দিবসে বিশ্বের সকল বাবাকে স্মরণ করছি,বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।কাব্যিক ভাষায় বলি,
“দুই অক্ষরের একটি নাম
বিশ্ব জুড়ে আছে সুনাম।
বাবা কখনো হয় না মন্দ,
বাবা সুখ,বাবা ই আনন্দ।
সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত গেলে যেমন আঁধার নপমে আসে,কৃত্রিম আলোর সহযোগিতা নিয়ে আমরা চোখে দেখি ঠিক তেমনি বাবাহীন এ জগতে নানা জনের কৃত্রিম সহযোগিতায় আমাদের জীবন চলে! বাবা একাই একক এক পৃথিবী।সেই পৃথিবীর সূর্য তিনি,সেই পৃথিবীর শাসক তিনি,সেই পৃথিবীর সকল আবদারের আধার তিনি।অথৈ সমুদ্রের নোনা জলরাশি যেমন সুপেয় নয়,পানের যোগ্য নয় তেমনি বাবাহীন এ পৃথিবীর সকল মানুষ যেন নোনা জলের মতো; জল তবে পানের যোগ্য নয়।সন্তানকে লালন পালন করতে বাবার নিজের ইদের নতুন জামা কেনার দরকার হয় না,নতুন ফোন,বাইক,বাড়ি কিছুই তাঁর নিজের পছন্দের হয় না,লাগে না; যাকিছু লাগে কেবল তাঁর সন্তানের জন্য।সদা উৎসর্গিত এমন মানুষ ই বাবা।আজ বাবা দিবসে বাবা ও বাবা সম্প্রদায়ের সকলের সুস্থতা কামনা করি এবং যাদের বাবা নেই তাদের জন্য সমবেদনা জ্ঞাপন করি। গানের ভাষায় বলি,” বাবা ভালো,মা ভালো,আমি যেন দু’জনের চোখের ই আলো।”
লেখক– মামুনার রশীদ