আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র তানজানিয়া সাম্প্রতিক নির্বাচনী সহিংসতায় রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। দেশটির বিরোধী দল চাদেমা দাবি করেছে, নির্বাচনের পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন এবং পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। এই ভয়াবহ সহিংসতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বিরোধীদের অভিযোগ—সহিংসতা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংঘটিত, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাই এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে তারা।
গত ২৯ অক্টোবর তানজানিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান বিপুল ব্যবধানে বিজয় লাভ করেন। সরকারি ফলাফল অনুযায়ী তিনি ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে এ ফলাফল দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। বিরোধী দল ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ তোলে—নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিরোধীদের ওপর হামলা, অপহরণ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নির্বাচন শেষে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যা একপর্যায়ে ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নেয়।
চাদেমার উপ-চেয়ারম্যান জন হেচে সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনের পরপরই সারাদেশে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তা স্পষ্টতই রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত। মাত্র সাত দিনে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত এবং পাঁচ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। এ ধরনের সহিংসতা কেবল রাজনৈতিক দমন নয়, বরং মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল।” তিনি আরও বলেন, সহিংসতার পেছনে পরিকল্পিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, নির্বিচারে আটক, লুটপাট ও হত্যার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত।
এ অভিযোগের আগে চাদেমা জানিয়েছিল—নির্বাচনী সহিংসতায় এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। কিন্তু নতুন হিসাব বলছে—প্রকৃত সংখ্যা আরও ভয়াবহ। তবে সরকার কোনও হতাহতের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। সরকার বলছে, দেশব্যাপী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী “প্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ” করেছে।
বিরোধীদের দাবি, নিহতদের মরদেহ পরিবারগুলোর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। অনেক মরদেহ গুম করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে জোরপূর্বক গুম, অপহরণ এবং বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সহিংসতার কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যাও হঠাৎ বেড়ে গেছে।
হেচে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “যারা এসব অপরাধের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে জড়িত, তাদের ওপর অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।”
অন্যদিকে নির্বাচনের পর সরকার বিরোধীদের ওপর কঠোর অবস্থান বজায় রাখছে বলে অভিযোগ করেছে চাদেমা। চলতি সপ্তাহের শুরুতে বিরোধীদের বিক্ষোভের ডাককে ঘিরে শহর ও গ্রামাঞ্চলের রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য ছিল। সর্বত্র ব্যাপক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিরোধীদের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হন বা আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন।
প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান সহিংসতার ঘটনা অস্বীকার না করলেও দাবি করেছেন—এটি সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় “প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা” ছিল। তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে পরিস্থিতির ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।” তবে দেশ-বিদেশের সমালোচকদের তোপের মুখে তিনি একটি তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা দেন। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ—কমিশনে কেবল সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই রয়েছেন, ফলে তদন্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বিরোধীদের দাবি—এমন একটি কমিশন কখনোই সত্যিকার চিত্র তুলে ধরতে পারবে না। তারা জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করছে।
তানজানিয়ার চলমান পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা আফ্রিকার ইতিহাসে নতুন ঘটনা না হলেও এত কম সময়ে এত বেশি প্রাণহানি বিরল। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বলছে—যদি বিরোধীদের দেওয়া সংখ্যাগুলো সত্য হয়, তবে তানজানিয়া এখন বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ রাজনৈতিক মানবিক সংকটের মুখোমুখি।
দেশটির দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতির নজির খুব কমই দেখা গেছে। সামিয়া সুলুহু হাসান প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর ভাবমূর্তি ইতিবাচক ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংসতা তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সমালোচকরা বলছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়েছে এবং রাজনৈতিক মতবিরোধ নির্মমভাবে দমন করা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রেফতার, নির্যাতন ও গুমের ভয়ে বহু মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। বাজার-ঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং যানচলাচলে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর টহল বেড়ে গেছে, এবং যেকোনো মুহূর্তে আরও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন-পরবর্তী উত্তপ্ত পরিস্থিতি প্রশমনে সরকারের কঠোর অবস্থান আরও সংকট তৈরি করছে। বিরোধীরা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে না। সমালোচকদের মতে, রাজনৈতিক অবস্থান কঠোর হওয়ার ফলে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি তলানিতে ঠেকেছে। বিরোধীদের বক্তব্য—যদি সহিংসতা ও দমন-পীড়ন বন্ধ না হয়, তবে তানজানিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তবে এখনো পর্যন্ত কোনও বড় শক্তি প্রকাশ্যে কঠোর অবস্থান নেয়নি। বিরোধীদের মতে, আন্তর্জাতিক চাপই সহিংসতা বন্ধের একমাত্র উপায়। যদি যথাসময়ে বিশ্ব সম্প্রদায় এগিয়ে না আসে, তবে তানজানিয়ার জনগণকে আরও ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্র: এএফপি