অনলাইন রিপোর্টারঃ
ঢাকা মার্কেন্টাইল কো–অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের (ডিএমসিএসএল) চেয়ারম্যান আবু জাফর চৌধুরী ও প্রতিষ্ঠানের ডিএমডি মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল অঙ্কের জালিয়াতি, প্রতারণা ও গ্রাহকের শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। একাধিক ভুক্তভোগী, গ্রাহক এবং প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মীদের বরাতে জানা গেছে—দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংঘটিত অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি ‘ব্যাংক’ শব্দ ব্যবহার করে সাধারণ গ্রাহকের কাছে নিজেদের ব্যাংকিং কার্যক্রমের মতো উপস্থাপন করে আসছে। উচ্চ মুনাফার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমানত সংগ্রহের নামেও সন্দেহজনক আর্থিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এভাবে বছরজুড়ে আমানত সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার গ্রাহকের অর্থ ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।
ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ অর্থ ব্যবস্থাপনায় সুসংগঠিত অনিয়ম করা হয়েছে এবং প্রতিবছর বিপুল অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। অভিযোগকারীরা বলেন, এসব অর্থ বিদেশে পাচারে মনিরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। তাদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ স্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে হুন্ডি, ভুয়া অডিট রিপোর্ট, কাগজে-কলমে কৃত্রিম লেনদেন ও কাল্পনিক প্রকল্প দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই অবৈধ অর্থে ডিএমডি মনিরুল ইসলাম রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি বাড়ি, ১৭টি ফ্ল্যাট এবং একাধিক গাড়ি ক্রয় করেছেন। স্বল্প কয়েক বছরের মধ্যে তার সম্পদ বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক হওয়ায় গ্রাহক ও সাবেক কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অভিযোগকারীরা বলেন—মনিরের ব্যক্তিগত প্রভাব, রাজনৈতিক যোগাযোগ এবং প্রশাসনের একটি অংশের অনুকূল আচরণ তাকে দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্ত রাখে।
অভিযোগ রয়েছে, আবু জাফর চৌধুরী ও মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অতীতে অনুসন্ধান শুরু হলেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সে অনুসন্ধান বারবার নষ্ঠ হয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট নানা অনিয়মের বিচার কখনো সামনে আসেনি। ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন যে, বিভিন্ন সময় তদন্ত সংস্থা কিছু নথি সংগ্রহ করলেও তা কার্যকর পদক্ষেপে রূপ নেয়নি।
মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে এর আগে শুশুকা গার্মেন্টস সংক্রান্ত জালিয়াতি, রাজউকের অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণ, আয়কর গোপন এবং কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকিরও অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে। গ্রাহকরা আরও অভিযোগ করেন—প্রতারণা ও অর্থপাচারের কাজে মনিরুল ইসলামকে সহযোগিতা করেছে তার স্ত্রী এবং আবু জাফর চৌধুরীর ভাগ্নি জামাই ওসামা। তাদের নামেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ে ওঠার অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা তদন্তের দাবি করছে পাহাড়সম প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে—যেখানে আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, লাভ-লোকসানের হিসাব, গ্রাহকের টাকার লেনদেন, বিনিয়োগ অনুমোদন—সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে অল্প কয়েকজন ব্যক্তি। ফলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। সিন্ডিকেটের স্বার্থে ভুয়া হিসাব তৈরি, কৃত্রিম লেনদেন, জমি কেনা-বেচার আড়ালে অর্থ পাচারসহ নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে।
বর্তমানে বহু গ্রাহক তাদের আমানত ফেরত না পেয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছেন। কেউ কেউ প্রতারণা মামলা করতে চাইলে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি বা চাপ প্রয়োগের অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। অনেকের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে গেলেও তা গোপন রাখতে অভ্যন্তরীণভাবে নানা উপায়ে হিসাব জালিয়াতি করা হয়।
অভিযোগগুলো প্রকাশ্যে আসার পর গ্রাহক ও ভুক্তভোগীদের একটি বড় অংশ দাবি তুলেছেন—অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একজন ‘অবজারভার’ নিয়োগ দিতে হবে, যাতে গ্রাহকের টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি সিন্ডিকেটের সদস্যদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দাবি উঠেছে। তারা মনে করেন, সঠিক তদন্তের জন্য বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের উৎস, লেনদেনের নথি এবং সম্পদের উৎস খুঁজতে হলে এই মুহূর্তে কঠোর নজরদারি জরুরি।
এদিকে সাধারণ গ্রাহকরা জানান, মার্কেন্টাইল কো–অপারেটিভ বর্তমানে একটি “হায় হায় কোম্পানিতে” পরিণত হয়েছে—কারণ যে হারে গ্রাহকের অর্থ অনিয়মের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, তাতে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর শঙ্কা বিরাজ করছে। ভুক্তভোগীরা বলেন—যত দ্রুত সম্ভব কঠোর তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া না হলে শত শত কোটি টাকা উদ্ধার অসম্ভব হয়ে যাবে।
এশিয়ানপোস্ট / এফআরজে