আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তিনি ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে ফেরত দেওয়ার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তবে ভারতের পক্ষ থেকে তাকে ফেরত দেয়ার কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল–জাজিরার অনলাইন সংস্করণে বিশ্লেষক যশরাজ শর্মা বিশ্লেষণ করেছেন কেন ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত দিতে চাইবে না।
২৪ বছর বয়সী সীমা আখতার ঢাকায় ফুটবল অনুশীলন করছিলেন, যখন বন্ধুরা জানালো শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সীমার মতো অনেকেই রায়টিকে ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক মনে করেন। গত বছর বাংলাদেশের বিক্ষোভ দমনে নিহতদের স্মরণে সীমার মতো অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড একটি ন্যায়বিচারের পদক্ষেপ।
তবে বাস্তবতা হল, কাজটি এত সহজ নয়। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ঢাকা ছেড়ে নয়াদিল্লিতে যান এবং সেখানে থেকে বাংলাদেশে ফেরত না যাওয়ায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা জানালেও, ভারত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণ দেখিয়ে তাকে ফেরত দেয়নি।
ভারত বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার পথ খুলে রাখতে আগ্রহী। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নয়াদিল্লি তাদের মিত্রদের প্রতি বিশ্বস্ততা বজায় রাখতে চাইছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তারা শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার মতো কোনো পদক্ষেপ নিতে নারাজ। ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, নয়াদিল্লি কিভাবে একজন ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি করে ফেরত পাঠাবে, এটা কল্পনা করাই কঠিন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং ১৯৯৬ সাল থেকে দীর্ঘকাল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। যদিও তার শাসনামলে নানা বিতর্ক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ২০২৪ সালের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমনে তার নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়, যা তার ক্ষমতা হারানোর অন্যতম কারণ।
ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস বহু গুণে জড়িত। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গভীর হলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা ও পারস্পরিক অনাস্থা মাঝে মাঝে সম্পর্কের গতি থামিয়ে দেয়। ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক পুরনো। ১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার হত্যাকাণ্ডের পর নয়াদিল্লি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছিল।
বর্তমানে নয়াদিল্লি বাংলাদেশে ‘ভারতবিরোধী শক্তি’ ক্ষমতায় থাকার অভিযোগ করে। শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ায় ভারতের রাজনীতি ও কূটনীতির মধ্যে বড় ধরণের প্রভাব পড়বে। ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়া মানে ‘ভারতবিরোধী শক্তিকে বৈধতা দেয়া’ হবে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা সবসময় গঠনমূলকভাবে বাংলাদেশসহ সব পক্ষের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এবং বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে কাজ করবে। তবে সম্পর্ক বর্তমানে শীতল। সাবেক হাইকমিশনার পিনাক চক্রবর্তী বলেন, আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হয়তো সম্পর্কের নতুন সূচনা হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ভারত জটিলতায় পড়েছে। তারা বাংলাদেশে শেখ হাসিনার প্রতি জনসমর্থন উপেক্ষা করতে পারেনা। ভারতের পক্ষে ভালো হবে নতুন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়া, কারণ হাসিনাকে আর কখনো ক্ষমতায় ফিরতে দেয়া হবে না।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যেও সাংস্কৃতিক বন্ধন অটুট। চীনের পর ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। তবে এখনকার রাজনৈতিক উত্তেজনা বাণিজ্যের গতিতে প্রভাব ফেলেছে।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সমৃদ্ধ ছিল যদিও বিরোধিতা ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নয়াদিল্লিতে আশ্রয় পেয়ে তিনি সেখানে বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের নৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক সূক্ষ্মতার কারণে তারা শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে চায় না। ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, তার উপস্থিতি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ‘কাঁটা’ হলেও ভারত তাদের মিত্রদের প্রতি বিশ্বস্ততা দেখিয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই অবস্থান ভারতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারে।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব ভবিষ্যতে সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা সম্ভব নয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে পারিবারিক নেতৃত্বাধীন দলগুলো সময়ের সঙ্গে পুনরুদ্ধার ক্ষমতা রাখে।