অনলাইন রিপোর্টার
অভিবাসনবিরোধী আন্দোলনে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে ইউরোপের দেশ আয়ারল্যান্ড। দেশটিতে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছে একাংশের জনগণ। রাজধানী ডাবলিনসহ বেশ কয়েকটি শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। গত দুই দিনে অন্তত ২৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে শুক্রবার রাতে অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নামে। প্রথমে শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে শুরু হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই তা সহিংস রূপ নেয়। দোকানপাট ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ— সব মিলিয়ে শহরজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন আহত হন, যাদের মধ্যে তিনজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য।
পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা শহরের কেন্দ্রস্থলে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও শনিবার আবারও রাজধানীর উত্তরের এলাকায় ছোট আকারে বিক্ষোভ হয়। এতে আরও ১১ জনকে আটক করা হয়।
পুলিশ কমিশনার ড্রিউ হ্যারিস বলেন, “আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করি, কিন্তু সহিংসতা ও ভাঙচুরের কোনো যৌক্তিকতা নেই। যে কেউ আইন ভাঙবে তাকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে।”
🔹 অভিবাসন ইস্যুতে সমাজে বিভাজন
আয়ারল্যান্ডে গত কয়েক বছরে ইউক্রেন, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা শরণার্থী ও অভিবাসীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দেশটির সামাজিক সেবার ওপর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় জনগণের একাংশ ক্ষোভ প্রকাশ করছে। অনেকেই দাবি করছেন, সরকারের অভিবাসন নীতি অযৌক্তিক এবং দেশীয় নাগরিকদের কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই বিক্ষোভ অভিবাসনবিরোধী ঘৃণা ছড়ানোরই অংশ। আয়ারল্যান্ডের সমাজ দীর্ঘদিন ধরে সহনশীলতার উদাহরণ হয়ে এসেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপজুড়ে ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান আয়ারল্যান্ডেও প্রভাব ফেলছে।
ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ড. লুসি ও’কনর বলেন, “অভিবাসনবিরোধী আন্দোলন এখন শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। কিছু গোষ্ঠী এই বিষয়টিকে ব্যবহার করে সমাজে বিভাজন তৈরি করছে।”
🔹 সরকারের কড়া অবস্থান
আয়ারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক ও বিপজ্জনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি সমাজে বিশ্বাস করি যেখানে মানুষ পরস্পরকে সম্মান করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সহিংসতা আয়ারল্যান্ডের মূল্যবোধের পরিপন্থী। যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সরকার জানিয়েছে, বিক্ষোভে অংশ নেওয়া যাদের ভিডিও ফুটেজে শনাক্ত করা যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো রোধে সাইবার ইউনিটও সক্রিয় হয়েছে।
এদিকে, পুলিশের বিশেষ ইউনিট জানিয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসনবিরোধী গোষ্ঠী বিদেশি রাজনৈতিক সংগঠন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে প্ররোচিত হচ্ছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।
🔹 অভিবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক
ডাবলিনের অভিবাসী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। নাইজেরিয়া থেকে আসা এক শরণার্থী বলেন, “আমরা এখানে শান্তিতে থাকতে এসেছি, কিন্তু এখন ভীতিতে আছি। কেউ বাইরে বেরোলে গালাগালি বা হুমকি পেতে হয়।”
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNHCR) জানিয়েছে, আয়ারল্যান্ডকে অভিবাসনপ্রবণ দেশ হিসেবে তার মানবিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। সহিংসতা বা ভয় দেখানো মানবাধিকারের পরিপন্থী।
🔹 ইউরোপে বাড়ছে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপজুড়ে অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি ও আন্দোলন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থনৈতিক সংকট, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সংকটের সুযোগে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে।
আয়ারল্যান্ডের ঘটনাও সেই ধারাবাহিকতার অংশ। সমাজে যে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে, তা শুধু রাজনীতি নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় হুমকি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এশিয়ানপোস্ট / এফআরজে