আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
**বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি মোতায়েন করল যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড চলতি সপ্তাহের শুরুতে লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে পৌঁছেছে। এটি মার্কিন নৌবাহিনীর সর্বাধুনিক ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধজাহাজ হিসেবে পরিচিত। এই রণতরির আগমনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি একপ্রকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ভেনেজুয়েলায় সামরিক অভিযান চালানোর ব্যাপারে তিনি অনেকটাই মনস্থির করে ফেলেছেন। উচ্চপর্যায়ের মার্কিন কর্মকর্তারা তাঁকে একাধিক দফায় ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে ব্রিফ করেছেন, এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প এই ধরণের সংকেত প্রকাশ করছেন। এর ফলে ক্যারিবীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার হয়েছে।
সিএনএন জানিয়েছে, মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে যে ‘অপারেশন সাউদার্ন স্পিয়ার’ নামে পেন্টাগন ঘোষিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্তমানে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ১২টির বেশি যুদ্ধজাহাজ এবং প্রায় ১৫ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। এসমস্ত জাহাজের মধ্যে রয়েছে রণতরির পাশাপাশি ক্রুজার, ডেস্ট্রয়ার, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কমান্ড জাহাজ, সাবমেরিন এবং এমন কিছু যুদ্ধজাহাজ রয়েছে যা জলে ও স্থলে একসাথে হামলা চালানোর সক্ষমতা রাখে।
গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, অবৈধ অভিবাসীর ঢল এবং মাদক পাচার বন্ধ করতে তিনি তাঁর লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছেন। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “হ্যাঁ, আমি অনেকটা মনস্থির করে ফেলেছি। সেটা কেমন হবে, আমি আপনাদের ঠিক বলতে পারছি না, তবে আমি একরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”
ট্রাম্পকে মার্কিন কর্মকর্তাদের ব্রিফিং ও আলোচনা
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল ড্যান কেইন সহ অন্যান্য শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা বুধবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভেনেজুয়েলায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযান পরিচালনার বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে বিস্তারিত ব্রিফ করেন। এরপর বৃহস্পতিবার ‘সিচুয়েশন রুমে’ জাতীয় নিরাপত্তা দলের সদস্যদের সঙ্গে ট্রাম্পের বড় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওসহ আরও অনেক শীর্ষ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকগুলোতে সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর ওপর বিস্তারিত আলোচনা হয়। ট্রাম্পকে ভেনেজুয়েলা নিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপের বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি স্থাপনা ও সামরিক ঘাঁটিতে বিমান হামলা, মাদক পাচারের রুটগুলোতে আক্রমণ এবং প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ।
এর আগেও সিএনএন জানায়, ট্রাম্প প্রশাসন কোকেন উৎপাদন কেন্দ্র ও মাদক পাচারের রুটগুলোকে লক্ষ্য করে অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করেছে।
সামরিক প্রস্তুতি ও যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রদর্শন
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড লাতিন ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে মোতায়েন হয়েছে। এটি মার্কিন নৌবাহিনীর সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। এই রণতরির সঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মার্কিন সেনা এবং ডজনখানেক যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রয়েছে। এই জাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:
একটি ক্রুজার
একাধিক ডেস্ট্রয়ার
বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কমান্ড জাহাজ
জলে ও স্থলে হামলার সক্ষমতা সম্পন্ন যুদ্ধজাহাজ
সাবমেরিন
মার্কিন সামরিক বাহিনী ক্যারিবীয় অঞ্চলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নৌ সেনা ও বিমান বাহিনী মোতায়েন করেছে। পাশাপাশি অন্তত ২০টি সন্দেহজনক মাদক পাচারকারী নৌকায় হামলা চালানো হয়েছে, যার উদ্দেশ্য মার্কিন বাজারে মাদকের প্রবাহ বন্ধ করা।
পুয়ের্তো রিকোতে সর্বাধুনিক ১০টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়েছে, যা ক্যারিবীয় অঞ্চলের সামরিক নজরদারির অংশ হিসেবে কাজ করছে। পুয়ের্তো রিকো বর্তমানে মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা এই সামরিক প্রস্তুতিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নজিরবিহীন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এর গবেষক এরিক ফার্নসওয়ার্থ বলেছেন, “এর মাত্রা ও গতি উভয়েই আমাকে বিস্মিত করেছে। চলতি শতাব্দীতে এই অঞ্চলে এটিই সবচেয়ে বড় সামরিক প্রস্তুতি। একই রকম পরিস্থিতির নজির খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৮৯ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্র পানামায় সামরিক অভিযান চালায়।”
ভেনেজুয়েলার প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক উপস্থিতির জবাবে ভেনেজুয়েলা ব্যাপকভাবে অস্ত্র, সরঞ্জাম এবং সেনা মোতায়েন শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো সরাসরি হুমকি দিয়েছেন যে, মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ হলে তা লাতিন আমেরিকায় ‘আরেকটি গাজা’, নতুন আফগানিস্তান অথবা ভিয়েতনাম পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
তার ভাষ্যে, “যারা দক্ষিণ আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে বোমা হামলা, হত্যা ও যুদ্ধ শুরুর নির্দেশ দেয়, তাদের উন্মত্ত হাত থামাও। যুদ্ধ থামাও। যুদ্ধকে ‘না’ বলো।”
সম্ভাব্য লাভ-ক্ষতি ও রাজনৈতিক প্রভাব
ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তন করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হতে হবে। সামরিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। তবে, প্রেসিডেন্ট মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মার্কিন প্রশাসন একটি বড় সাফল্যের দাবি করতে পারবে, যা আগে অনেক প্রশাসন করতে পারেনি। ২০১৯ সালে ভেনেজুয়েলায় বিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদোকে বৈধ নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েও তিনি ক্ষমতা গ্রহণে সক্ষম হননি।
ট্রাম্প যদি মাদুরোকে উৎখাত করতে পারেন, তবে তিনি নিম্নলিখিত অর্জনগুলো দাবি করতে পারবেন:
ক্ষমতাধর নেতাকে সরিয়ে নির্বাচিত নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা
মাদক ও অবৈধ অভিবাসীর ঢল রোধে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি
জ্বালানি তেল নিয়ে সম্ভাব্য চুক্তির পথ খুলে দেওয়া
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, মাদুরোকে সরানোর জন্য ভেনেজুয়েলার ভেতরে হামলার নির্দেশ দিলে ট্রাম্প গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন সেনা মোতায়েনের বিষয়টি ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পেছনে থাকা রাজনৈতিক জোটকেও বিরক্ত করতে পারে, কারণ তারা দেশের বাইরে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সমর্থন জানিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি
ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ— যারা নিজে ইরাক যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে ছিলেন—দুটোই দেশের বাইরের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ানো নিয়ে অনীহা প্রকাশ করে আসছেন।
ট্রাম্পের জন্য এটি একটি কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হতে পারে, যেখানে তাকে সামরিক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সমর্থন দুটি সামঞ্জস্য করতে হবে।