রফিকুল ইসলাম রাজু
গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) হামলা অব্যাহত রেখেছে। গাজার সরকারি প্রশাসনের জনসংযোগ দপ্তর জানিয়েছে, ১০ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ৯ দিনে ৯৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং কমপক্ষে ২৩০ জন আহত হয়েছেন। এই সময়কালকে ঘিরে ৮০টি আলাদা সংহিসতার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে, যেখানে যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে হামলা চালানো হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিদিন যুদ্ধবিরতির শর্ত উপেক্ষা করে গাজার বেসামরিক এলাকায় গুলি চালাচ্ছে। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করা, ইচ্ছাকৃতভাবে সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক দিয়ে তল্লাশি চালানো এবং গ্রেপ্তারী অভিযান চালানো—সবই যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে। গাজার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় এখনও বিমান ও ড্রোন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যদিও আগের তুলনায় হামলার মাত্রা কিছুটা কমানো হয়েছে, তবুও গাজার ওপর চাপ এখনও বিরাট।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার জন্য একটি নতুন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিলেন। গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস এবং ইসরায়েল উভয়ে এই প্রস্তাবে সম্মতি জানালে, ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয় যুদ্ধবিরতি। এর আগে, টানা দুই বছর ধরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত চলার ফলে প্রায় ৬৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি আহত হয়েছিল।
গাজার প্রশাসনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে সমস্ত ইসরায়েলি সেনা গাজা থেকে প্রত্যাহার করবে—এই প্রতিশ্রুতি এখনও পূর্ণভাবে পালন করা হয়নি। আমাদের জনগণের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধবিরতি মানা হচ্ছে না।”
এই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও নজরে এসেছে। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছে, বেসামরিকদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘন। বিশেষ করে শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ইতিমধ্যেই ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি হয়েছে, হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও ঔষধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
হামলা চলাকালীন সময়ে গাজার নাগরিকরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। বহু পরিবার গ্রাম ও শহরের উভয় অংশে নিরাপদ স্থান খুঁজে পায়নি, যার ফলে তাদের জীবন ও নিরাপত্তা বিপন্ন হচ্ছে। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। গাজার বেসামরিক নাগরিকদের প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানোও কঠিন হয়ে উঠেছে।
মেডিকেল সোর্সেস বলছে, আহতদের মধ্যে কমপক্ষে ৪৫ শতাংশ গুরুতর আহত, যা অবিলম্বে চিকিৎসার প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্তদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক চাপ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে PTSD (Post Traumatic Stress Disorder) দেখা দিচ্ছে এবং তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বড় হচ্ছে।
গত কয়েক বছরের সংঘাতের ইতিহাসে দেখা গেছে, গাজায় এই ধরনের যুদ্ধবিরতি প্রায়শই অল্প সময়ের জন্য কার্যকর হয়। ইসরায়েলি বাহিনী হামলা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা প্রায়শই অমান্য হয়। ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করছে। হামলা প্রতিরোধে এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগেরও দাবি উঠেছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘ, হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং উভয় পক্ষকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, গাজার বেসামরিকদের জীবন ও মানবিক অধিকার সুরক্ষা মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
গাজায় যুদ্ধবিরতির সময়কালে যে সহিংসতা ঘটেছে তার মধ্যে রয়েছে—গোলাবর্ষণ, বেসামরিকদের ওপর হামলা, বাড়ি ধ্বংস, স্কুল ও হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ধরনের লঙ্ঘন তদন্ত করার দাবি তুলেছে।
এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনি জনগণ মানবিক সংকটে পড়েছে। খাদ্য, পানি এবং চিকিৎসার অপর্যাপ্ত সরবরাহ তাদের জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা এবং স্থানীয় মানবিক সংগঠনগুলো এই সংকট মোকাবেলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে।
গাজার হাসপাতালগুলোতে গুরুতর আহতদের চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে গেছে। অস্ত্রোপচার, জরুরি চিকিৎসা ও জীবনরক্ষাকারী ঔষধের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবকরা ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু সঠিক মানবিক সহায়তা পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, গাজায় যুদ্ধবিরতির পরও হামলার কারণে ফিলিস্তিনিরা দৈনন্দিন জীবন ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। আহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে এবং বেসামরিকদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে যাতে শান্তি প্রক্রিয়া কার্যকর হয় এবং মানবিক সহায়তা দ্রুত পৌঁছে।
এশিয়ানপোস্ট / আরজে