এশিয়ান পোস্ট ডেস্কঃ
একসময় ধারণা ছিল, যত বেশি দেশ ভ্রমণ করা যাবে এবং পাসপোর্টে যত বেশি দেশের ভিসা থাকবে, পাসপোর্ট তত বেশি ‘ভারী’ হবে। উন্নত দেশগুলো সহজে ভিসা দেবে। তবে, দিন বদলে গেছে। বর্তমানে সবুজ মলাটের বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে অধিকাংশ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেরই যেন ‘অ্যালার্জি’। ভিসা দেওয়া তো দূরের কথা, যেসব দেশে ভিসা ‘অন-অ্যারাইভাল’ সুবিধা চালু আছে, সেসব দেশও বাংলাদেশিদের প্রবেশ করতে না দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠাচ্ছে।

যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স প্রতি বছর বিশ্বের শক্তিশালী পাসপোর্টের সূচক প্রকাশ করে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮তম। দীর্ঘ দুই দশক ধরে অবনতি হয়ে বর্তমানে অবস্থান ৯৪-এ, যা মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ফিলিস্তিন ও আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়ার সঙ্গে সমান। ২০২৩ সালে অবস্থান আরও শোচনীয়ভাবে ১০১তম।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘একটি দেশ অন্য দেশের নাগরিককে সাধারণত ভিসা ইস্যু করে যেন ওই ভিসাধারী ব্যক্তি সে দেশে ভ্রমণ করে তাদের অর্থনীতিতে সহায়তা করে। কিন্তু অনেক বাংলাদেশি পর্যটন ভিসা নিয়ে অবৈধভাবে ওভারস্টে করেন, অবৈধভাবে কাজ করেন। এতে দেশ ও মানুষের ওপর নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এই কারণেই অনেক দেশে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না, বা অফলোড করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিশৃঙ্খল মনোভাবের কারণে বিদেশি কর্মকর্তারা মনে করেন বাংলাদেশিরা সেখানে অপকর্ম করতে পারে। ফলে তারা সতর্ক থাকে। আমরা যদি নিজেদের ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারি, তখনই ভিসা প্রক্রিয়া সহজ হবে।’

গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরেও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ভিসা প্রক্রিয়ার সময় দীর্ঘ হচ্ছে, প্রত্যাখ্যানের হার বাড়ছে এবং পুরনো সুবিধাগুলো সীমিত হচ্ছে। ভিসাপ্রাপ্তির পরও অনেক বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীকে ‘অফলোড’ করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো পর্যটননির্ভর দেশগুলোও বাংলাদেশিদের বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। এই দেশগুলোতে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণে ভিসা অন-অ্যারাইভাল সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাংলাদেশিকে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
ইন্দোনেশিয়া একসময় বিনামূল্যে অন-অ্যারাইভাল ভিসা দিত। এখন সেখানে সহজে ভিসা পাওয়া যাচ্ছে না। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ভারত নতুনভাবে ভিসা কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। দুবাই ও আবুধাবির মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশও নতুন করে ভিসা প্রদান স্থগিত রেখেছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ভিসা অনীহার প্রধান কারণ হলো ভিসার অপব্যবহার ও অবৈধ অভিবাসন। অনেক বাংলাদেশি পর্যটন ভিসা নিয়ে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে প্রবেশ করে দেশের অনুমোদন ছাড়াই থাকে। ভিসার মেয়াদ শেষ হলে লুকিয়ে কাজ করে, বা গ্রেপ্তার হয়ে দেশে ফেরে। এছাড়া কিছু দেশ অভিযোগ করছে, বাংলাদেশিরা এই ভিসা রুট ব্যবহার করে অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যায়।

চলতি বছরের জুলাই ও আগস্টে বাংলাদেশি পর্যটককে বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানোর তথ্যও মিলেছে। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ জানিয়েছে, পর্যটকরা হোটেল বুকিং, পর্যাপ্ত ভ্রমণকালীন অর্থ, বা আত্মীয়দের ঠিকানা প্রদর্শনে ব্যর্থ হলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইমিগ্রেশন শাখা জানিয়েছে, অনেক দালাল পর্যটককে ভিসা ভুয়া উদ্দেশ্যে পাঠায়। বিমানবন্দরে লাইন থেকে পিছু হটে লুকিয়ে থাকার কৌশল শেখায়। এই কারণে মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখলে অতিরিক্ত সতর্ক হন।
শুধু কাজের উদ্দেশ্য নয়, মালয়েশিয়াকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে অনেকে লিবিয়া, ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে। থাইল্যান্ডও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কঠোর হচ্ছে। বাংলাদেশিদের পাসপোর্টে ৬ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট, সলভেন্সি সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্সসহ ডজনখানেক নথি জমা দিতে হচ্ছে।

নেপাল ও শ্রীলঙ্কা কিছুটা ভিন্ন। নেপাল বিনামূল্যে টুরিস্ট ভিসা দেয়, কিন্তু ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা সন্দেহজনক যাত্রীকে ফিরিয়ে দেয়। শ্রীলঙ্কাতেও অন-অ্যারাইভাল ভিসা পেলে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।
টোয়াব সভাপতি রাফিউজ্জামান রাফি বলেন, ‘পর্যটনবান্ধব প্রতিবেশী দেশগুলো ভিসা বন্ধ করে দিয়েছে। ভারত, কাতার, বাহরাইন, মিশর, দুবাই, আবুধাবি, ভিয়েতনাম বন্ধ করেছে। ভিসা প্রক্রিয়া জটিল করার কারণে পর্যটক কমে যাওয়ায় ট্যুর অপারেটররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সরকারের উচিত দ্রুত প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করা।’
এশিয়ান পোস্ট / এফআরজে