আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
ইউরোপে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে এখন ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় দ্রুতগতির শক্তিশালী নৌকা ব্যবহার করছে পাচারকারীরা। এসব নৌকার গতি এত বেশি যে অনেক সময় উপকূলরক্ষীদের পক্ষে এগুলো থামানো বা আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে যাত্রার সময় যেমন কমছে, তেমনি ঝুঁকিও বহু গুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহুদিন ধরে ছোট রাবার নৌকা ও ডিঙ্গি ছিল অনিয়মিত অভিবাসনপথের প্রধান বাহন; তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পাচারকারীরা ব্যবহার করছে এমন নৌকা, যেগুলোর ইঞ্জিনের শক্তি প্রায় ১৪০০ হর্সপাওয়ার—যা রেসিংয়ে ব্যবহৃত একটি ফর্মুলা–১ গাড়ির ইঞ্জিনের সমপর্যায়ের।
এ ধরনের নৌকার দৈর্ঘ্য সাধারণত ১৪ মিটার পর্যন্ত হয় এবং এদের গতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটারেরও বেশি। ফলে বেশিরভাগ সীমান্তরক্ষী নৌকার পক্ষে এগুলো শনাক্ত বা ধাওয়া করা খুব কঠিন। এক উপকূলরক্ষী কর্মকর্তা জানান, এসব নৌকা থামানোর প্রায় কোনো বৈধ উপায় নেই—গুলি করলে বা ধাক্কা দিলে যাত্রীদের প্রাণহানি নিশ্চিত। তিনি আরও বলেন, নৌকাগুলো যেন ‘ফেরারি’, আর এগুলো চালায় অনভিজ্ঞ মানুষ, যাদের অধিকাংশ সময় কিছুই বিবেচনায় থাকে না।
সীমান্ত নজরদারিতে যুক্ত কর্মকর্তাদের মতে, দ্রুতগতি ও সহজে দিক বদলের ক্ষমতার কারণে এসব নৌকা চিহ্নিত করা কঠিন হয়। লিবিয়া থেকে ইতালি এবং মরক্কো–আলজেরিয়া উপকূল থেকে স্পেনমুখী রুটে গত কয়েক মাসে এমন নৌকার ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। মরক্কোর পূর্বাঞ্চল কিংবা আলজেরিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে যাত্রা করলে স্প্যানিশ ভূখণ্ডে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টার অল্প বেশি সময় লাগে, যা পাচারকারীদের কাছে সবচেয়ে লাভজনক সময়ব্যবস্থা।
দক্ষিণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গত বছরও একই প্রবণতা দেখা গেছে। কিছু অনুমান অনুযায়ী, অনিয়মিত পথ ধরে ইউরোপে পৌঁছানো অভিবাসীদের প্রায় অর্ধেকই শক্তিশালী মোটরচালিত নৌকায় যাত্রা করেছিলেন। এসব নৌকায় যাত্রার খরচও তুলনামূলক বেশি—একজনকে ছয় থেকে ১৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত দিতে হয়, যা রাবার নৌকা বা কাঠের নৌকায় যাত্রার খরচের প্রায় দশগুণ।
দ্রুত যাত্রার সুবিধা থাকলেও ঝুঁকি কমে না, বরং আরও বেড়ে যায়। উন্নত উপকরণে তৈরি হলেও এসব নৌকা অতিরিক্ত গতির কারণে প্রাণঘাতী হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এত গতিতে কেউ পানিতে পড়ে গেলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত, কারণ পানির পৃষ্ঠ তখন প্রায় কংক্রিটের মতো শক্ত হয়ে ওঠে। তাছাড়া ইউরোপীয় পানিসীমায় কম সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে নৌকা উপকূলে পৌঁছার আগে পাচারকারীরা গতি কমিয়ে দেয় এবং অনেক যাত্রীকে পানিতে লাফিয়ে সাঁতার কেটে তীরে যেতে বাধ্য করে। অনেক সময়ে অস্ত্রের মুখে জোর করে সাঁতার কাটতে বলা হয়।
অনিয়মিত যাত্রার শুরুতেও অনেককে অগভীর জল ঠেলে সাঁতার কেটে নৌকায় উঠতে হয়, যাতে নৌকা বালিতে আটকে না যায় বা ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। একই সঙ্গে একাধিক নৌকা পাঠিয়ে পাচারকারীরা উপকূলরক্ষীদের মনোযোগ বিভ্রান্ত করে, যা সংঘর্ষ ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়ায়।
উচ্চ ভাড়ার কারণে অনেক যাত্রী নানা ধরনের চাপের শিকার হন। কেউ কেউ বাধ্য হন শ্রম বা যৌন সহিংসতার বিনিময়ে খরচ পরিশোধ করতে। আবার কিছু যাত্রীকে ইউরোপে পৌঁছার পর যৌনকর্মে যুক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে হয়। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো—সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু অভিবাসীকে পাচারকারীরা ‘মাদকবাহী’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ছোট প্যাকেটে মাদক বহন করিয়ে মানুষের পেটের ভেতর লুকিয়ে নেওয়া হয়, যা ফেটে গেলে তাৎক্ষণিক ওভারডোজে মৃত্যু ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে অভিবাসীদের আগে থেকে এই তথ্যও জানানো হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্রুতগতির নৌকা এখন পাচারকারীদের কাছে একসঙ্গে দুই ধরনের ব্যবসা—মানুষ পাচার ও মাদক পাচার—দুটিতেই লাভ বাড়ানোর সবচেয়ে সহজ মাধ্যম। ফলে ভূমধ্যসাগরের এই বিপজ্জনক পথ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।