আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে যুক্তরাজ্যে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি বাংলাদেশি আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। এদিকে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘অবৈধ অভিবাসী ও অপরাধীদের’ ফেরত নিতে সহায়তা না করলে কয়েকটি দেশের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি আফ্রিকার কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করে বলেছে, ‘অবৈধ ও অপরাধী’ নাগরিকদের ফেরত না নিলে সেসব দেশের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। পরবর্তী ধাপে অন্যান্য দেশও এই ধরনের কঠোর নীতির লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
আশ্রয়প্রার্থীর হার বেশি এমন দেশগুলোর নাগরিকদের বৈধ পথে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভিসা প্রদানে কঠোরতা আরোপ করা হতে পারে বলেও প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।
নিয়মিত পথে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ: কারা এগিয়ে?
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সবশেষ উপাত্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের দেশটিতে অভিবাসনের জন্য মোট ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৭টি ভিসা ইস্যু করা হয়েছে। কর্মসংস্থান, পড়াশোনা, পারিবারিক পুনর্মিলন বা মানবিক কারণ দেখিয়ে এসব ভিসা ইস্যু করা হয়েছে।
এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভিসা পেয়েছেন ভারতের নাগরিকেরা, যার মোট সংখ্যা ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭০টি। ইস্যু করা মোট ভিসার প্রায় ২০ শতাংশ বা প্রতি পাঁচটি ভিসার একটি পেয়েছেন এই দেশটির নাগরিকেরা।
এরপরের অবস্থানে চীন। দেশটির নাগরিকদের ১ লাখ ১৪ হাজার ১৭৮টি ভিসা প্রদান করা হয়েছে। মোট ভিসার হারে এটি ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। যুক্তরাজ্যের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে পরবর্তী অবস্থানে আছে পাকিস্তান (৬৯ হাজার ৫৮০ বা ৮.৩ শতাংশ), নাইজেরিয়া (৪৫ হাজার ৯৬৬ বা ৫.৫ শতাংশ) এবং যুক্তরাষ্ট্র (৩০ হাজার ৮৯৮ বা ৩.৭ শতাংশ)।
যে তিনটি দেশকে উল্লেখ করে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাদের ভিসা ইস্যুর হার চলতি বছর বেশ কম ছিল। এর মধ্যে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোকে ২৯৯টি, অ্যাঙ্গোলাকে ২৭২টি এবং নামিবিয়াকে দেওয়া হয়েছিল ১৪০টি ভিসা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, পারিবারিক পুনর্মিলন ও মানবিক কারণে যুক্তরাজ্যের ভিসা ইস্যুর সংখ্যা আগের ১২ মাসের তুলনায় ৩২ ভাগ কমেছে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে যেখানে ১২ লাখ ২৩ হাজার ৮৯৯টি ভিসা প্রদান করা হয়েছিল, চলতি জুন পর্যন্ত ১২ মাসে তা নেমে এসেছে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৭টিতে।
অনিয়মিত পথে যুক্তরাজ্য ভ্রমণে শীর্ষে যারা
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে বৈধভাবে আসার জন্য ভিসা প্রদানের হার কম এমন দেশের নাগরিকেরা অনিয়মিত পথে দেশটিতে আসায় এগিয়ে আছেন। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১২ মাসের হিসাবে অনিয়মিত পথে আগতদের অর্ধেকই পাঁচটি দেশের নাগরিক। দেশগুলো হলো আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া, ইরান, সুদান ও সিরিয়া।
যুক্তরাজ্যে মোট অনিয়মিত অভিবাসনে ৫৫ শতাংশ এই পাঁচটি দেশ থেকে হয়েছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান, শিক্ষা, পারিবারিক পুনর্মিলন বা মানবিক কারণে যুক্তরাজ্যে আসার ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে এই দেশগুলোর অংশ ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।
গত জুন পর্যন্ত এক বছরে অনিয়মিত পথে যুক্তরাজ্যে আসা ৪৮ হাজার ৪৭৮ জনের জাতীয়তা জানা গেছে। তাদের অধিকাংশ (৪২ হাজার ৪৪৬ জন) এসেছেন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে। আগতদের ৬ হাজার ৫৮৯ জন বা ১৩ শতাংশ আফগান। বাকিদের মধ্যে ইরিত্রিয়ার ৬ হাজার ২৬৭ জন (১২.৯ শতাংশ), ইরানের ৫ হাজার ৩৬৭ জন, সুদানের ৪ হাজার ৩১৮ জন (৮.৯ শতাংশ) এবং সিরিয়ার রয়েছেন ৪ হাজার ২১৬ জন (৮.৭ শতাংশ)।
জুন পর্যন্ত আগতদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর রয়েছেন মাত্র ১১ জন। ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে অ্যাঙ্গোলার তিনজন আর নামিবিয়ার কেউ ছিল না এই পরিসংখ্যানে।
আশ্রয় আবেদন: বাংলাদেশিরা শীর্ষ পাঁচে
২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১২ মাসে বিভিন্ন দেশের ১ লাখ ১১ হাজার ৮৪ জন যুক্তরাজ্যে আশ্রয় আবেদন করেছেন। ২০০১ সাল থেকে নথিবদ্ধ হিসাবে যা সর্বোচ্চ। এই আবেদনকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ২৩৪ জন বা ১০ শতাংশ পাকিস্তানি। এছাড়া ৮ হাজার ২৮১ জন (৭.৫ শতাংশ) আফগান, ৭ হাজার ৭৪৬ জন (৭ শতাংশ) ইরানিয়ান এবং ৭ হাজার ৪৩৩ জন (৬.৭ শতাংশ) ইরিত্রিয়ান।
এই তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। চলতি বছর জুন পর্যন্ত ১২ মাসে ৬ হাজার ৬৪৯ জন বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। মোট আশ্রয় আবেদনের মধ্যে বাংলাদেশিদের হার ৬ শতাংশ।
এক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকিতে থাকা ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর ১৩৪ জন, নামিবিয়ার ১০৪ জন এবং অ্যাঙ্গোলার রয়েছেন ২৭ জন। উল্লিখিত সময়ে ৯০ হাজার ৮১২ জন তাদের আশ্রয় আবেদনের প্রাথমিক ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন। এর মধ্যে পাকিস্তানের ৮ হাজার ২০০ জন, সিরিয়ার রয়েছেন ৭ হাজার ৩৩১ জন।
আশ্রয় আবেদনের ফলাফল জানার অপেক্ষমান তালিকায় বাংলাদেশিরা রয়েছেন তৃতীয় অবস্থানে। ৬ হাজার ৮৩৮ জন বাংলাদেশি এখনও তাদের আশ্রয় আবেদনের প্রাথমিক ফলাফল জানতে পারেননি। অপেক্ষমান তালিকায় থাকাদের মধ্যে এই সংখ্যা সাড়ে ৭ শতাংশ। তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছেন আফগান (৬ হাজার ৭৮৪ জন) ও ভারতীয়রা (৫ হাজার ৭৩ জন)।
যুক্তরাজ্যের কারাগারে আটক কত বিদেশি
যুক্তরাজ্যের বিচার মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের শেষে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের কারাগারে ১০ হাজার ৭৩৭ জন বিদেশি নাগরিক বন্দি ছিলেন।
মোট কারাবন্দিদের মধ্যে বিদেশি নাগরিকদের অনুপাত গত বছরের তুলনায় সামান্য বেড়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে তা হয়েছে ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। গত এক দশক ধরেই এই হার প্রায় ১২ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।
সেপ্টেম্বরের শেষে যুক্তরাজ্যের কারাগারে বন্দিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৮৬ জন ছিলেন আলবেনিয়ান। সংখ্যার দিক থেকে এরপর রয়েছেন পোলিশ (৭৭৬ জন), আইরিশ (৬৭৭ জন), রোমানিয়ান (৬৭৫ জন) এবং ভারতীয়রা (৩৬৪ জন)।
কারাগারে বন্দিদের মধ্যে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর ৫৬ জন, অ্যাঙ্গোলার ৩৯ জন এবং নামিবিয়ার রয়েছেন ৯ জন।
যুক্তরাজ্য সরকার কী বলছে
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাবানা মাহমুদ অনিয়মিত অভিবাসনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি দেশটির আশ্রয় আবেদন প্রক্রিয়ায় কড়াকড়ি আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। এছাড়া সাময়িক সময়ের জন্য শরণার্থী মর্যাদা দেওয়ার এবং পরে নিরাপদ বিবেচিত হলে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কথাও বলেছেন তিনি।
‘অবৈধ অভিবাসী ও অপরাধীদের’ ফেরত নিতে যথেষ্ট সহায়তা না করার অভিযোগ এনে অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া ও ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর প্রতি ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী অ্যালেক্স নরিস স্কাই নিউজকে বলেন, দেশগুলোর কাছে “এটি ঠিক করার জন্য এক মাস সময় আছে।”
শুধু এই তিন দেশ নয়, অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বিবেচনা করার কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। এর মধ্যে যেসব দেশের নাগরিকদের আশ্রয় আবেদনের হার বেশি এবং ফেরত নেওয়ার নীতির ক্ষেত্রে যারা সহায়তা করবে না তাদের উপর ‘জরুরি নিষেধাজ্ঞার’ পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে সরকার। ইনফোমাইগ্রেন্টস