অনলাইন রিপোর্টার
শৈশবে ডাকনাম ছিল পুতুল। বিয়ের পর খালেদা খানমের সঙ্গে যুক্ত হয় স্বামীর নামের একাংশ। দিনাজপুর ও ফেনীতে বেড়ে ওঠা সেই পুতুল একসময় দেশে-বিদেশে পরিচিত হন খালেদা জিয়া নামে।
জীবনের ৭৯ বসন্তে খালেদা খানমের খালেদা জিয়া হয়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল শেষ চার দশক। যেটির শুরু হয় ১৯৮১ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও স্বামী জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়া ছিলেন ঘোর অনাগ্রহী। কিন্তু সাধারণ এই গৃহবধূকে রাজনীতিতে টেনে আনে অকাল বৈধব্যের নিয়তি।
তখনকার উথালপাথাল রাজনীতির মঞ্চেও খালেদা জিয়া টিকে যান জনতার সমর্থনে। সামরিক শাসকের প্রলোভনে যখন সহযোদ্ধারা একে একে ছেড়ে যাচ্ছিল, তখনও গণতন্ত্রের পক্ষে শিরউন্নত রেখে সমর্থকদের চোখে হয়ে ওঠেন আপসহীন। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি থেকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েও আপস করেননি। জীবনের শেষ বছরগুলোতে অশক্ত শরীরেও ছিলেন দৃঢ়চেতা নেত্রী। তাঁর সেই সংগ্রামী জীবনকে থামিয়েছে মৃত্যু।
গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ইন্তেকাল করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ৭৯ বছরের অর্জনপূর্ণ জীবনের অবসানেও তাঁর জন্য শোকস্তব্ধ বাংলাদেশ। শুধু কর্মী-সমর্থক নন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিযোগী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন।
পৌষের কনকনে শীতের ভোরে খালেদা জিয়ার প্রয়াণ খবর ছড়িয়ে পড়লে, থমকে যায় পুরো দেশ। হাজারো মানুষ ছুটে আসেন হাসপাতালে। ভেতরে-বাইরে ওঠে কান্নার রোল। নির্বাচনী মৌসুমেও দিনভর রাজধানীর পথঘাট ছিল তুলনামূলকভাবে ফাঁকা।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা মৃত্যু সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোর পর টিভি পর্দায় এসে একই খবর দেশবাসীকে জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ঘোষণা করেন বুধবার সাধারণ ছুটি এবং তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক।
সরকারিভাবে জানানো হয়েছে, আজ বুধবার সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বাদ জোহর দুপুর ২টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজার পর তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন স্বামী জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে। খালেদা জিয়ার পার্থিব শরীর রাখা হয়েছে এভারকেয়ারের হিমঘরে। সেখান থেকে আজ বুধবার সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কড়া নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় নেওয়া হবে জানাজাস্থলে।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন শোক জানিয়েছেন। শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা। খালেদা জিয়ার জানাজায় যোগ দিতে ঢাকায় আসছেন পাকিস্তানের স্পিকার সরদার আয়াজ সাদিক। শ্রদ্ধা জানাতে আসবেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করসহ শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন নেত্রী অভিধা পাওয়া খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪১ বছর। তিনি পাঁচবার এমপি, তিনবার প্রধানমন্ত্রী; আর দুবার বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। কখনও নির্বাচনে হারেননি। চার দশকের রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, কারাগারে গিয়েছেন; কিন্তু দেশ ছাড়েনি।
সেনাসমর্থিত এক-এগারোর সরকারের সময়ে শেখ হাসিনা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশ চলে গেলেও, জেলজীবন কাটান খালেদা জিয়া। দেশ ছাড়েনি। ২০১৮ সালে দণ্ডিত হওয়ার আগের বছরে ছিলেন লন্ডনে। মামলা মাথায় নিয়ে ফিরে আসেন দেশে। এই দৃঢ়তাই তাঁকে সমর্থকদের কাছে দেশনেত্রীতে পরিণত করে।
শোকস্তব্ধ দেশ
খালেদা জিয়ার মৃত্যু সংবাদে বিভিন্ন জেলায় পথে পথে মানুষ নেমে আসে। হাসপাতালের সামনে বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক ছাড়াও হাজারো সাধারণ মানুষ ভিড় করেন। জায়গাটি পরিণত হয় শোক, নীরবতা ও আবেগের এক প্রাঙ্গণে। কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউ চোখ মোছেন, কেউ আবার দুই হাত তুলে দোয়া করেন।
হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সদের অনেককেও কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যমে লাখো মানুষ শোক জানান খালেদা জিয়ার জন্য। শত শত মানুষ বলেন, এই বেদনা শুধু নেতা হারানোর নয়, মাতৃহারা হওয়ার।
কেউ খালেদা জিয়ার শাসনামলের অর্জনের কথা লেখেন। কেউ লেখেন, গণতন্ত্রের জন্য তাঁর লড়াইয়ের কথা। জনগণের ভোটাধিকারের জন্য খালেদা জিয়ার ১৫ বছরের সংগ্রাম, ২৫ মাসের কারাবাসের কথা আসে। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানোর চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন তিনি।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিএনপি সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে বলে জানিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সব কার্যালয়ে সাত দিন কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। নেতাকর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। প্রতিটি দলীয় কার্যালয়ে সাত দিনব্যাপী কোরআন খতম ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।
নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলা পর্যায়ে দলীয় কার্যালয়ে শোক বই খুলেছে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দলের নেতা গতকাল গুলশান কার্যালয়ে শোক বইয়ে খালেদা জিয়ার প্রতি তাদের অনুভূতির কথা জানান।
এলো দুঃসংবাদ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরদিন গত বছরের ৬ আগস্ট স্থায়ীভাবে কারামুক্ত হন খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি হেঁটে কারাগারে গেলেও, ২৫ মাস পর সাময়িক মুক্তিতে বেরিয়ে আসেন হুইলচেয়ারে করে। এর পরের পৌনে ৬ বছর বাসার চেয়ে হাসপাতালে বেশি থাকতে হয়। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাজ্যে তিন মাসের চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হলেও রোগমুক্ত হতে পারেননি।
গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে শেষবারের মতো জনসমক্ষে আসেন খালেদা জিয়া। স্বাস্থ্যের অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। লিভার, কিডনির জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও ইনফেকশনজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি।
অবস্থার গুরুতর অবনতি হলে বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পরিবারের সদস্যরা সোমবার গভীর রাতে হাসপাতালে ছুটে যান। রাত ২টার পর এ জেড এম জাহিদ হোসেন হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়া অত্যন্ত সংকটকালীন সময় অতিক্রম করছেন।
এর কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিএনপি চেয়ারপারসনকে মৃত ঘোষণা করেন। তারেক রহমান, তাঁর স্ত্রী জোবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান, খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর (প্রয়াত) স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান, দুই মেয়ে জাহিয়া ও জাফিয়া রহমান, খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, প্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, খালেদা জিয়ার মেজ বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সময় হাসপাতালে ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর সময়ে শয্যাপাশে ছিলেন তারেক রহমান।
গতকাল সকাল ৯টায় খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার সাংবাদিকদের সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘দীর্ঘ এক মাস ১০ দিন বিভিন্ন চিকিৎসা করে ওনাকে সুস্থ করতে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল। কিন্তু মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে আজ ভোর ৬টায় তাঁকে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা করেছিলাম। তিনি আর নেই। দেশবাসীর কাছে তাঁর জন্য দোয়া চাই। তিনি যেন বেহেশতবাসী হন।’
খালেদা জিয়ার মৃত্যু সংবাদ ঘোষণার সময়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘এই সংবাদটি নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে হবে, কখনও ভাবিনি। এই শোক, এই ক্ষতি অপূরণীয়।’
শোক নিয়ে জরুরি বৈঠকে তারেক
মাতৃহারা হওয়ার ছয় ঘণ্টার মধ্যে দলীয় দায়িত্বে ফিরতে হয় তারেক রহমানকে। খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে দুপুর সাড়ে ১২টায় তাঁর সভাপতিত্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জরুরি বৈঠক হয়। জ্যেষ্ঠ নেতারাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। সভাপতিত্ব করা তারেক রহমান অশ্রুসংবরণ করলেও ছিলেন শোকে স্তব্ধ। সহকর্মীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ওই বৈঠক চলে। অংশ নেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও হাফিজ উদ্দিন আহমদ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার জানাজায় ইমামতি করবেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব। জানাজা সঞ্চালনা করবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
এশিয়ানপোস্ট/ এফআরজে