এশিয়ান পোস্ট ডেস্ক
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ‘চিকেনস নেক’ হিসেবে পরিচিত শিলিগুড়ি করিডোর ঘিরে সম্প্রতি ভারতের সামরিক তৎপরতা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। আসাম ও উত্তর দিনাজপুরে দুটি নতুন সেনা ঘাঁটি স্থাপনের কাজ শুরু করেছে ভারত।
ভারত ও বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শিলিগুড়ি করিডোরের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। পাশাপাশি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তৈরি নতুন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও এই সামরিক তৎপরতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, চিকেনস নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য বা ‘সেভেন সিস্টার্স’কে সংযুক্ত করেছে। এই অঞ্চলে একাধিক দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে।
চীন এই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য যে তৎপরতা চালাচ্ছে, সেটিও ভারতের বড় উদ্বেগের কারণ বলে সামরিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অন্যদিকে, লালমনিরহাটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গুজব ছড়ানো হয় যে সীমান্তের ৬২ কিলোমিটার এলাকা ভারতের দখলে চলে গেছে। বিবিসি বাংলা সরেজমিনে লালমনিরহাট গিয়ে পরিস্থিতি যাচাই করলে দেখা যায়, বিজিবি ও স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকরা এ ধরনের কোনো দখলের কথা অস্বীকার করেছেন।
লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের কিছু অংশ নিয়ে বিজিবি ব্যাটালিয়ন ১৫ এর আওতায় প্রায় দেড়শ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম জানান, গুজবটি সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, সীমান্তে বিজিবি টহল দেয় এবং সরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না।
সীমান্তের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের সঙ্গে বিজিবির নিয়মিত যোগাযোগ ও যৌথ টহল চলছে। ধরলা নদী ভারত-বাংলাদেশের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী এবং লালমনিরহাট সীমান্তের মোগলহাট বিওপির কাছে নদী দুই দেশে বিভক্ত।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা বলেন, জমি ভারতের দখলে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা লালমনিরহাটে ঘটেনি। কেউ কেউ দাবি করেছেন, সীমান্তে বিএসএফ কড়া পাহারা দিচ্ছে এবং ৫ আগস্টের পর থেকে তাদের টহল ও জনবল বেড়েছে।
শিল্পী বেগম নামে এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, আগে নিয়মিত সীমান্তের কাছে যেতেন, এখন সেখানে যান না কারণ বিএসএফ সদস্যদের টহল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়াকড়ি হয়েছে।
সীমান্তে বিএসএফের গুলির ঘটনাও কমেনি। গত ১১ নভেম্বর ভারতের ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশের পর বিএসএফ গুলি চালায়, যার ফলে তিনজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন।
ভারতের সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি শিলিগুড়ি করিডোরে ভারতের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এ বছরের শুরুতে ভারতের তিন বাহিনীর সম্মিলিত একটি বড় ধরনের সামরিক মহড়া শিলিগুড়ি করিডোর এলাকায় হয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অন্তত দুটি নতুন সেনা ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে—আসামের ধুবরি ও উত্তর দিনাজপুরের চোপরা। এই জায়গাগুলো বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছাকাছি অবস্থিত।
ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জী বলেন, এটি সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ। শিলিগুড়ি করিডোর ভারতের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা। বর্ডারে বিএসএফ দায়িত্ব পালন করে, সেনাবাহিনী সেখানে সাধারণত মোতায়েন থাকে না। বর্তমান সময় কিছু স্থাপনার র্যাশনালাইজেশন করা হচ্ছে।
অমিত শাহ সীমান্তে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং চিকেনস নেক তার অংশ। ডোকলাম থেকে শিলিগুড়ি করিডোরে সেন্সিটিভ পরিস্থিতি রয়েছে বলে ভারত মনে করছে এবং প্রস্তুত থাকতে হবে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে ভারতের সামরিক তৎপরতার কোনো সরাসরি যোগসূত্র নেই বলে দীপঙ্কর ব্যানার্জী উল্লেখ করেন। এটি সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়ানোর স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, বিশেষ করে চীনের প্রভাবকে মাথায় রেখে।
তিনি বলেন, “১৯৭১ সালের আগেও বড় পরিসরে অনুপ্রবেশ হয়েছে। এটি ভারতবর্ষের কাছে দীর্ঘদিনের সমস্যা।”
লালমনিরহাট বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী ইমাম জানান, ভারতীয় সেনা ঘাঁটিগুলো সীমান্তরক্ষী ফোর্স হিসেবে কোনো উদ্বেগের বিষয় সৃষ্টি করেনি। তারা নির্দিষ্ট দূরত্বে নিজেদের কার্যক্রম চালাতে পারে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
বাংলাদেশের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী বলছেন, ভারতের পদক্ষেপের তিনটি মূল কারণ হলো শিলিগুড়ি করিডোরের সুরক্ষা, চীন মোকাবিলা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে হুমকির অনুভূতি।
তিনি বলেন, “শিলিগুড়ি করিডোর সেভেন সিস্টার্সকে সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এর তাৎপর্য বেড়েছে।”
চীনের সিপ্যাক ও সিম্যাক প্রকল্পসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা ভারতের জন্য চিন্তার বিষয়। তাই তারা শিলিগুড়ি করিডোরকে ‘থ্রেট’ হিসেবে দেখে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক যোগাযোগ বাড়ায় ভারত উদ্বিগ্ন।
শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে লালমনিরহাট বিমানবন্দর ও তিস্তা প্রকল্পে চীনের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতিও ভারতের উদ্বেগের অন্যতম কারণ।
নাঈম আশফাক চৌধুরী ভারতের সামরিক পদক্ষেপকে বাংলাদেশে কোনো আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে না দেখে ‘গ্রে জোন ব্যাটল’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এর মাধ্যমে সরাসরি যুদ্ধ না করেই চাপ তৈরি করা হবে।
তিনি বলেন, “ভারতের স্বার্থের বিপরীতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যেন হুমকি অনুভব করি।”
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশকে খুব সতর্কতার সঙ্গে সামরিক কূটনীতি বজায় রাখতে হবে এবং দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যকার যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে।”
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো ভারতবিরোধী অবস্থান নিচ্ছে বলে দেখা যায়।
ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপঙ্কর বলেছেন, ভারত সামরিক দিক থেকে বাংলাদেশকে কোনো হুমকি মনে করে না।
বাস্তবতা হলো, ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান সীমান্তে নিয়মিত গণ্ডগোল চলছে, কিন্তু পূর্বাঞ্চল সীমান্তে বাংলাদেশকে ভারত শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে না। তবে কৌশলগত কারণে সীমান্তে অন্য কেউ সুযোগ নেওয়া গেলে তা ভারতের উদ্বেগের বিষয়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এশিয়ান পোস্ট / এফআরজে