আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বাছাইয়ের চূড়ান্ত বৈঠকটি হয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণার একেবারে কাছাকাছি সময়ে। এমনটাই বলা হয়েছে দ্য নোবেল প্রাইজ ওয়েবসাইটে। দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে শান্তিতে নোবেল পাওয়ার যোগ্য দাবি করে আসছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঠিক সেই সময়েই আবারও আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি।
আগামীকাল শুক্রবার ঘোষণা হবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নাম। এর আগের দিন বুধবার ট্রাম্প দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নে সম্মত হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। তাঁর দাবি অনুযায়ী, এর আগে তিনি সাতটি যুদ্ধ ও সংঘাত বন্ধ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস ফ্যাক্ট-চেক করে জানিয়েছে, এসব দাবি পুরোপুরি সত্য নয়।
ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে জানিয়েছে পাকিস্তান ও ইসরায়েল। এ ছাড়া কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী, ইউক্রেনের রাজনীতিক এবং যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও নরওয়ের কয়েকজন আইনপ্রণেতাও তাঁর নাম প্রস্তাব করেছেন। তবে ট্রাম্প একা নন—তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী ৩৩৮ জন প্রার্থী রয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে সংঘাত আর সহিংসতার মধ্যেই এ বছর শান্তিতে নোবেল পাওয়ার জন্য রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়ন জমা পড়েছে। ২৪৪ জন ব্যক্তি ও ৯৪টি প্রতিষ্ঠান এই তালিকায় আছেন। এটি গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২৪ সালে প্রার্থী ছিলেন ২৮৬ জন, আর সর্বাধিক প্রার্থী ছিলেন ২০১৬ সালে—৩৭৬ জন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা করা হয় নরওয়ের অসলো শহরে। মনোনয়ন জমার শেষ দিন ছিল ৩১ জানুয়ারি। কারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তা ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন রাখে কমিটি। তবে কিছু নাম প্রকাশ্যে আসে মনোনয়নদাতাদের মাধ্যমে—যেমন ট্রাম্পের ক্ষেত্রে ইসরায়েল ও পাকিস্তান প্রকাশ করেছে তাদের সুপারিশপত্র।
গত জুলাইয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে উপহার দেন তাঁর পাঠানো একটি চিঠির কপি—যা নোবেল কমিটির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাতে ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। এর এক মাস আগে পাকিস্তানও ট্রাম্পের নাম মনোনীত করার কথা জানায়। উভয় দেশই দাবি করে, ট্রাম্প বিশ্বে যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করছেন।
নোবেল ফাউন্ডেশনের বিধি অনুযায়ী, কেবল নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষই বৈধভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন দিতে পারেন। যেমন—সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান; আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ও স্থায়ী সালিশি আদালতের সদস্য; আন্তর্জাতিক আইনের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সদস্য; বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, আইন, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক; পূর্ববর্তী নোবেল বিজয়ী ও নোবেলপ্রাপ্ত সংগঠনের বোর্ড সদস্যরা; নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির বর্তমান ও সাবেক সদস্য এবং উপদেষ্টারা।
মনোনয়ন জমার পর ১ ফেব্রুয়ারি নোবেল কমিটি প্রথম বৈঠক করে। সেখানে স্থায়ী সচিব প্রার্থীদের পূর্ণ তালিকা উপস্থাপন করেন। কমিটি চাইলে সেখানে নতুন নাম যোগ করতে পারে। এরপর মনোনয়ন প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে যায় এবং সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি হয়—সাধারণত ২০ থেকে ৩০ জনকে নিয়ে। এই প্রার্থীদের নিয়ে কাজ করেন নোবেল ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টারা, যারা কয়েক মাস ধরে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করেন। পরে কমিটি এসব বিশ্লেষণ পর্যালোচনা করে অক্টোবরের শুরুতে চূড়ান্ত বিজয়ী নির্বাচন করে। সর্বসম্মতি না হলে ভোটে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকেই ট্রাম্প নিজেকে ‘শান্তির দূত’ বলে দাবি করে আসছেন। তিনি বলছেন, অন্তত সাতটি যুদ্ধ বন্ধ করেছেন। কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমস–এর তথ্যমতে, এসব সংঘাত এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। আজারবাইজান-আর্মেনিয়া, কঙ্গো-রুয়ান্ডা, ভারত-পাকিস্তান, ইরান-ইসরায়েল—সব জায়গাতেই যুদ্ধ বা সংঘাত থেমেছে সাময়িকভাবে, কিন্তু স্থায়ী সমাধান আসেনি। এমনকি তিনি যে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির দাবি করেছেন, সেটিও বাস্তবে কার্যকর হয়নি—ওই ঘোষণার সময়ও তেল আবিব গাজায় হামলা চালাচ্ছিল।
জাতিসংঘ অধিবেশনের সময়ও ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, তিনি সাতটি যুদ্ধ বন্ধ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে যাচাই-বাছাইয়ে দেখা যায়, সেসব চুক্তির বেশিরভাগই ছিল সাময়িক বা আনুষ্ঠানিক নয়। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তি ছিল যৌথ ঘোষণাপত্র, কোনো বাস্তব শান্তিচুক্তি নয়। কঙ্গো-রুয়ান্ডার চুক্তির পরও সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যস্থতা ছিল আংশিক, আর ইরান-ইসরায়েল সংঘাতও আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি।
অসলো শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিনা গ্রেগার মনে করেন, ট্রাম্প যদি রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শেষ করতে বাস্তব কোনো সাফল্য দেখাতে পারেন, তবে তিনিও নোবেল পাওয়ার যোগ্য প্রার্থী হতে পারেন। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর ভূমিকা বিতর্কিত। কারণ তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করেছেন, যার ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একইসঙ্গে তাঁর নেতৃত্বে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, যা বৈশ্বিক শান্তি ও অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে।
নোবেল পুরস্কার প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেলের উইলে বলা হয়েছে, “এই পুরস্কার সেই ব্যক্তিকে দেওয়া উচিত যিনি জাতিগুলোর মধ্যে সৌহার্দ্য বৃদ্ধির জন্য সর্বাধিক কাজ করেছেন।” কিন্তু ট্রাম্প কি আসলেই সেই কাজ করেছেন? প্রশ্ন থেকে যায়। তবুও ইতিহাসে এমন অনেক বিতর্কিত নেতা রয়েছেন যারা শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন—যেমন ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হেনরি কিসিঞ্জার, ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক, বা পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত।
ট্রাম্পের সমর্থকরা দাবি করেন, ২০২০ সালের ‘আব্রাহাম চুক্তি’ তাঁর শান্তিপ্রচেষ্টার প্রমাণ। ওই চুক্তির মাধ্যমে আরব উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, এটি মধ্যপ্রাচ্যের গভীর রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনেনি।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির এক সদস্য দ্য টেলিগ্রাফ-কে বলেছেন, প্রার্থীদের পক্ষে চাপ সৃষ্টি বা প্রচারণা নোবেল জেতার সম্ভাবনা কমিয়ে দিতে পারে। কমিটি এমন লবিং পছন্দ করে না, বরং সেটি উল্টো ফল দেয়। তাই ট্রাম্পের প্রচারণা তাঁর জন্য সহায়ক না হয়ে ক্ষতিকরও হতে পারে।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, শান্তিতে নোবেল প্রার্থী ৩৩৮ জনের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প সবচেয়ে আলোচিত হলেও, বাস্তব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। ইতিহাস বলে, বিতর্কিত ব্যক্তিরাও কখনো কখনো নোবেল পেয়েছেন—কিন্তু সেক্ষেত্রে তাঁদের অর্জনই শেষ পর্যন্ত কথা বলেছে। এখন দেখার বিষয়, ২০২৫ সালের নোবেল কমিটি কী সিদ্ধান্ত নেয়।
এশিয়ানপোস্ট / এফআরজে