বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ০১:৫১ অপরাহ্ন
নোটিশ :
Eid Bazar ! Eid Bazar ! Held on 30th March Saturday @ Paterson Firemanhall, Adress 226 Walnut ST, Paterson, NJ 07522 /  9th International Women's Day Award Held on April 27, 2024 @ The Brownston, 251 West Broadway, Paterson, NJ .7522 Ticket 70 Dollar Per Person Get Tickets From www.eventbrite.com

পানামা খাল দখলের হুমকি: ট্রাম্পের ভাবনায় ‘আঞ্চলিক সম্প্রসারণ’

রিপোর্টার / ১৩৭ বার
আপডেটের সময় : বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫, ০১:৫১ অপরাহ্ন

পানামা খাল দখলের হুমকি  : ট্রাম্পের  ভাবনায়আঞ্চলিক সম্প্রসারণ‘ – মুহাম্মদ মোরশেদ আলম

বিশ্বের অন্যতম ও ব্যস্ততম জলপথ হচ্ছে পানামা খাল। এটি বৈশ্বিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার জাহাজ চলাচল করে। আর এ খালটির মালিকানা পানামা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি অভিযোগ করেছেন, মধ্য আমেরিকার দেশটি মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর ওপর অত্যধিক ফি আরোপ করছে। বর্তমান সময়ে এসেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশ অন্য একটি সার্বভৌম দেশের কাছে তার ভূখণ্ড ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছে-এমন নজিরবিহীন ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। যদিও মি. ট্রাম্প বলেননি যে, তিনি কীভাবে এটি করবেন।

গত  ২২ ডিসেম্বর আরিজোনায় ‘আমেরিকাফেস্ট’ অনুষ্ঠানে মি. ট্রাম্প বলেন, ‘পানামা খালের মাধ্যমে আমাদের প্রতারণা করা হয়েছে। এটি আমাদের দেওয়া উচিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র বোকামি করে এটি ছেড়ে দিয়েছে।’   পরে ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ পানামা খালের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ওড়ানো একটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের খালে স্বাগতম!’

ট্রাম্প তার পোস্টে পানামা খাল এবং এর আশপাশে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, এটি (খালটি) কেবল পানামার ব্যবস্থাপনার জন্যই ছিল, চীন বা অন্য কারও জন্য নয়। আমরা এবং আমরা কখনোই এটি ভুল হাতে পড়তে দেব না!  ট্রাম্প আরো বলেন, ‘যদি নৈতিক এবং আইনি উভয় দিক বিবেচনা করে মহৎ পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে আমরা পানামা খাল দ্রুত এবং সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি করব।’

ট্রাম্পের এই বক্তব্যের পর পরই প্রতিবাদ জানিয়েছেন পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো। সামাজিক মাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘পানামা খালের প্রতি বর্গমিটার এবং এর আশপাশের এলাকা পানামার অধীনে ছিল এবং থাকবে। এ খাল আমাদের ইতিহাসের অংশ ও একটি অপরিবর্তনীয় অর্জন।’ তিনি আরও বলেন, পানামা খালের ওপর চীনের কোনও প্রভাব নেই।  তিনি আরও বলেন, ‘চীনের সঙ্গে সম্পর্কিত হংকংভিত্তিক সিকে হাচিসন হোল্ডিংস শুধু খালের দুটি বন্দর পরিচালনা করে।’

লাতিন আমেরিকার দেশ পানামার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ ছিল। তবে, গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে পানামার সাথে চীন নতুন করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা শুরুর পরই পানামার সাথে সম্পর্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ভাবনা তৈরি হয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রই এই খালটিকে সবচে বেশি ব্যবহার করে থাকে।

প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্তকারী ৫১ মাইল বা ৮২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই কৃত্রিম খালটি ১৯১৪ সালে নির্মাণ করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কনটেইনারের ৪০ শতাংশই এই খাল ব্যবহার করে।  এশিয়া থেকে পণ্য আমদানি এবং এলএনজি রপ্তানিতে খালটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ১৯৯৯ সালে একটি চুক্তির মাধ্যমে খালটির মালিকানা পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তর করে যুক্তরাষ্ট্র।  এই খালটির কারণে এশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলের মধ্যে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ প্রান্তে বিপজ্জনক পথ অতিক্রম করতে হয় না। পানামা খাল না থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজগুলোকে দক্ষিণ আমেরিকার কেইপ হর্ন হয়ে চলাচল করতে হতো। পানামা খাল নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিকো অভিমুখী জাহাজগুলোর ২০ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব ছেঁটে ফেলেছে।

ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং পরদিন ২৩ ডিসেম্বর বেইজিংয়ে এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পানামা খালের টোল নির্বিচারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এবং খালটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনও বড় দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। ‘পানামা খাল পানামার জনগণের একটি মহান সৃষ্টি এবং একটি সোনালি জলপথ, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে সংযুক্ত করে। চীন সবসময়ই খালের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পানামার জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করে আসছে। চীন বরাবরের মতোই পানামাকে সম্মান করবে।’ ২০২৩ সালে মধ্য আমেরিকায় যে খরা দেখা দেয়, তার আঁচ পড়ে পানামা খালেও। খালটির জলকপাট পরিচালনা করতে কাছের কৃত্রিম গাতুন হ্রদের ওপর নির্ভর করতে হয়। হ্রদে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় খাল কর্তৃপক্ষ ওই জলপথে জাহাজের সংখ্যা সীমিত করার পাশাপাশি ব্যবহারের মাশুল বাড়িয়ে দেয়।

## ঐতিহাসিক পটভূমি : ১৯০৩ সালে কলম্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে পানামা। এ ঘটনার সঙ্গেও পানামা খালের সম্পর্ক রয়েছে। ফরাসিরা একটি খাল খননের উদ্যোগ নিলেও সফল হতে পারেনি। এরপর এগিয়ে আসে মার্কিনরা। দুই পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, খাল খননের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিজেদের জমি ও জলসীমা ছেড়ে দেয় পানামা। ৩৮ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে সময় লাগে ১০ বছর। খালটি ১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে নির্মিত হয়, বেশিরভাগ অংশই করে যুক্তরাষ্ট্র। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট নির্মাণ কাজের তদারকি করেন। অবশেষে ১৯১৪ সালের ১৫ আগস্ট পানামা খাল আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। প্রথম একটি স্টিমার খালটি অতিক্রম করে। পানামা খাল খননে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। খননকাজ চলার সময় বিভিন্ন রোগ ও দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়। আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছিল পানামা খাল। শুধু তাই নয়, সেখানে একটি বিশেষায়িত ‘ক্যানাল জোন’ বা ছিটমহলের মতো খাল অঞ্চল গড়ে তুলেছিল ওয়াশিংটন। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি, পুলিশ, এমনকি বিচারব্যবস্থা কার্যকর ছিল।

পানামার মানুষের মধ্যে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করা আর পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিন ধরে ছিল। বিভিন্ন সময় এই দাবি উঠে এসেছে। অবশেষে ১৯৭৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার স্বাক্ষরিত এক চুক্তির আওতায় ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র খালটির মালিকানা পানামার কাছে হস্তান্তর করে। পানামার জাতীয়তাবাদী নেতা ওমর তোরিজোস ও তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বেশকিছু চুক্তিতে সই করেন। চুক্তিগুলোয় ৪০টির বেশি দেশ সমর্থন দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পানামা খালকে ‘নিরপেক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ খাল দিয়ে যেকোনো নৌযান চলাচলের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে একটা শর্ত রয়েছে। তা হলো নৌযানগুলোকে খালের নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট বিধান মেনে চলতে হবে। আর যুদ্ধরত দেশগুলোর সামরিক নৌযান একই সময়ে একসঙ্গে খাল পার হতে পারবে না।

চলতি শতকের শুরুতেও পানামা খাল বেশ সংকীর্ণ ছিল। তবে ২০০৯ ও ২০১৬ সালে খালটি সম্প্রসারণ করা হয়। বর্তমানে ৩৬৬ মিটারের (প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট) বেশি দীর্ঘ আর ৪৯ মিটারের (প্রায় ১৬১ ফুট) বেশি প্রস্থের নৌযান পানামা খাল দিয়ে চলাচল করতে পারে।

## বিশ্ববাণিজ্যে অবদান : নৌপথে পরিচালিত বিশ্ববাণিজ্যের ৫ শতাংশে পানামা খালের সরাসরি অবদান রয়েছে। ১৭০টি দেশের ১ হাজার ৯০০-এর বেশি বন্দরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে এ খালের ভূমিকা রয়েছে। পানামার জাতীয় অর্থনীতির ৬ শতাংশের জোগান দেয় পানামা খাল। ২০০০ সালের পর থেকে খালটি দেশের জাতীয় আয়ে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার যোগ করেছে। সবশেষ অর্থবছরে ১১ হাজার ২০০টির বেশি নৌযান পানামা খাল অতিক্রম করেছে। কন্টেইনারবাহী এসব জাহাজ মূলত গাড়ী, প্রাকৃতিক গ্যাস, সামরিক উপকরণসহ বিভিন্ন পণ্য পরিবহন করে থাকে। এসব নৌযানে ৪২ কোটি ৩০ লাখ টনের বেশি পণ্যবাহী কার্গো পরিবহন করা হয়েছে। গত অক্টোবরে, পানামা খাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা গত অর্থবছরে রেকর্ড ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।

## ট্রাম্পের লক্ষ্য ‘আঞ্চলিক সম্প্রসারণ’ : নভেম্বরের ভোটের আগে ট্রাম্পের নির্বাচনি প্রচারে জোর দেওয়া হয়েছিল ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতির ওপর। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি একাধিকবার ‘আঞ্চলিক সম্প্রসারণের’ ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন, যার মধ্যে পানামা খালকে তিনি সম্ভাবনা হিসেবে দেখছেন।

কানাডার দিকেও নজর দিয়েছেন ট্রাম্প। গেল ১৮ ডিসেম্বর ট্রুথ সোশ্যালে তিনি লিখেছেন, ‘অনেক কানাডিয়ান চায় কানাডা (যুক্তরাষ্ট্রের) ৫১তম অঙ্গরাজ্য হোক। তাতে কর ও সামরিক সুরক্ষার খরচায় ব্যাপকভাবে তাদের সাশ্রয় হবে। আমি মনে করি, এটি একটি দুর্দান্ত ভাবনা। ৫১তম স্টেট!!’ তবে এ বিষয়ে ট্রাম্প ‘সিরিয়াস’ কি না তা স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। ট্রাম্প সম্প্রতি কানাডার পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দেওয়ার পর দেশটির অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ওপর পদত্যাগের চাপ বাড়ে। ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প সোমবার বলেন, ‘ডেনমার্কে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসাবে কেন তিনি হাওয়ারিকে বেছে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ একটি সন্দেহাতীত প্রয়োজন।’ ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদেও এই ভাবনার কথা বলেছিলেন, কিন্তু ডেনিশ কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয়।

আগামী ২০শে জানুয়ারি শপথ নিতে যাচ্ছেন আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার শপথ গ্রহণের পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে এটি তারই ইঙ্গিত ।  পানামা খালকে নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য বিশ্বমঞ্চে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু পানামা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে না, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও উত্তেজনার কারণ হতে পারে।

মুহাম্মাদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক


এ জাতীয় আরো সংবাদ

এক ক্লিকে বিভাগের খবর